শুধু সামরিক বিভাগেই স্যার হাফরোজের অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ নয়। তিনি কুটনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। ২০ বছর চাকুরি করে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেলের পদে উন্নীত হয়েছেন। তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পুনা বিভাগের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। বুন্দেলার সদারদের নিরপেক্ষ বোধ করায় তিনি সাগারে অভিযান করতে মনস্থ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা করলেন। বিদ্রোহীরা রাহাতগড়ে তাকে বাধা দিলো। বনপুরের বুন্দেলা রাজা মর্দান সিং সেপাইদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তিনি দেখলেন যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলে তিনি হৃতরাজ্য উদ্ধার করতে পারবেন এবং স্থানীয় ঠাকুরদের সহায়তায় ঐতিহাসিক দুর্গ অধিকার করতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করেও রাহাতগড়ের অবরোধ ভেদ করতে সক্ষম হলেন না। তারপর বিদ্রোহীরা বীনার ববদিয়া নামক স্থানে চলে এলো। দৃঢ়চিত্তে আফগান এবং পাঠানদের অল্পসংখ্যক সৈন্য প্রাণপণ বিক্রমে দুর্গ প্রতিরক্ষা করেন। কিন্তু তাদের দলপতি প্রাণ হারালেন, আবার এদিকে বনপুরের রাজাও আহত হয়েছেন। সে স্থান ত্যাগ করতে হলো। ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে স্যার হাফরোজ সাগার-এর কাছাকাছি এসে গেলেন। গারাকোটাকে মুক্ত করে স্যার হাফরোজ ঝাঁসীর দিকে অভিযান করা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। যানবাহনের অভাবে তাঁর যাত্রা দু’দিনের জন্য স্থগিত রাখতে হলো। তার পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করার আগে স্যার হাফরোজ সেনাবাহিনীর প্রত্যেক শাখার উন্নয়ন সাধন করলেন। স্যার হাফরোজ পেছনের দিক দিয়ে চাখারী হয়ে কল্পিতে গিয়ে সেখান থেকে ঝাঁসীতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কেননা কল্পির রাজা হলেন ব্রিটিশ সরকারের একেবারে গোড়া সমর্থক। তার সৈন্য বাহিনীর পক্ষে ঝাঁসীর দুর্গ দখল করা কষ্টসাধ্য হবে বলে তিনি মনে করলেন। কিন্তু তিনি মনে করলেন আবার পেছনে এ রকম শক্তিশালী শত্রু-দুর্গ রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ২১শে মার্চ তারিখে ব্রিটিশ সৈন্য ঝাঁসীতে এসে উপনীত হলো। এ সময়ে স্যার হাফরোজের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্ট।
ঝাঁসী থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকতেই স্যার হাফরোজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলো। কানপুরের পরাজয় তাতিয়া টোপীকে নিরস্ত করতে পারেনি। তিনি পেছন দিক নিয়ে ক্ষুদ্র বুন্দেলা রাজ্যের ক্ষুদ্র রাজধানী আক্রমণ করে বসলেন। রাজা অসহায়ভাবে ব্রিটিশ সেনাপতির কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেন। সুতরাং হাফরোজ তিলমাত্র সময় নষ্ট না করে বুন্দেলার রাজাকে রক্ষা করার কথা ভাবলেন। যাহোক সেখানে যাওয়া হলো না। অতঃপর তিনি ঝাঁসীর দিকে একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।
২২শে মার্চ তারিখে অবরোধ করা হলো। ২৫ তারিখে কামান থেকে গোলাবর্ষণ হতে লাগলো। নগরবাসীরা কামানের গুলী দিয়ে শত্রুদের অভ্যর্থনা করলো। মহিলারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সন্ধ্যাবেলা তাঁর সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করার জন্য রাণী নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। তিনি বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা করছিলেন। তাদের আসতে বেশি সময়ের দরকার হলো না। ৩১শে মার্চ তারিখে তাঁতিয়া টোপীর পরিচালনাধীন ২০ হাজার সৈন্য ঝাঁসীতে এলো। স্যার হাফরোজ কিছু সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর তাঁতিয়া টোপীর সৈন্যবাহিনীকে হটিয়ে দিলেন।
তাঁতিয়া টোপীকে পরাজিত করে স্যার হাফরোজ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁসী আক্রমণ করলেন। তাঁতিয়া টোপীর সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবনের ফলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিলো কিনা বলা যায় না। ৩রা এপ্রিল তারিখে তারা শত্রুর ওপর প্রবল অগ্নিবৃষ্টি শুরু করলো। ঘটি, বাটি, বটি, দা, কুড়াল হাতের কাছে যা পেলো শত্রুর প্রতি ছুঁড়ে মারতে লাগলো। অবশেষে নগরীর ফটক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো এবং ব্রিটিশ সৈন্য দ্রুতবেগে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। কিন্তু একটি বিরাট পাথরখণ্ড প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো। তাদের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু আরেকটি দল ছোট্ট একটি ফাটল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এখন যুদ্ধ শহরের রাজপথে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষাকারীরা প্রতিটি স্থানে বীরবিক্রমে লড়ে যাচ্ছে। বিনা যুদ্ধে এক পা অগ্রসর হবারও উপায় নেই। শত্রুরা প্রতিটি কক্ষে হামলা চালালো। কিন্তু সঙ্গিনের মুখে তাদের পালিয়ে আসতে হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যের দখলে চলে এলো প্রাসাদ। তখনও রাণীর ৪০জন দেহরক্ষী বীর বিক্রমে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কিছু সংখ্যক একটি কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলো। সে কক্ষে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। তাদের কাপড়ে আগুন ধরে গেলো। অর্ধদগ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা সে ঘরেই রয়ে গেলো। পরের দিন প্রাসাদ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে যুদ্ধ চললো। প্রত্যেক ভারতীয়কে যুদ্ধ করুক বা না করুক শত্রু বলে ধরে নিয়ে হত্যা করা হলো। যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো না তারা কূয়াতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো।
ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রবল আক্রোশ ছিলো রাণীর উপর। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পুরুষের বেশে পালক পুত্রসহ পালিয়ে গেলেন। তাঁরা ছিলেন একদল আফগান রক্ষী। ওরচা প্রহরীদের দৃষ্টিকে তারা ফাঁকি দিয়েছিলো। কিন্তু সকাল হবার পূর্বে তারা আরেকটি ঘাঁটির সম্মুখীন হলেন। তাঁর রক্ষীবৃন্দসহ রাণী কল্পির দিকে অশ্বারোহণে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা মামা সাহেব পথ হারিয়ে ফেলেন এবং ধৃত হন। তাঁকে ঝাঁসীতে পাঠিয়ে দেয়া হলে জোখনবাগে শূলে চড়ানো হয়। অশ্বারোহণে রাণী একরাতে ২১ মাইল পথ অতিক্রম করে গেলেন। কিন্তু তার অন্তর্ধানের সংবাদ ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে অজ্ঞাত ছিলো। সকালে ক্যাপটেন ফর্বস এবং লেফটেন্যান্ট ডকারকে ৩১নং হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী এবং ১৪নং পল্টনসহ পাঠিয়ে দেয়া হলো। রাণীর চল্লিশ জন দেহরক্ষী ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে লাগলো। তার মধ্যে উনচল্লিশ জন একে একে মারা গেলো। বাকী রইলো কেবল মাত্র একজন। রাণী ছিলেন সুদক্ষা অশ্বারোহী। অনুসরণকারীদের সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিটি রাণীর গুলির আঘাতে ধরাশায়ী হলো।