এ সরল সহজ পত্রের ভাষার মধ্যে কোনো রকমের ঘোরপ্যাঁচ নেই। রাণী স্পষ্টই স্বীকার করেছেন, তাঁকে বিদ্রোহীদের সামরিক তহবিলে চাঁদা দিতে হয়েছে। সেপাইদের সঙ্গে কোনো রকম ষড়যন্ত্রে যদি লিপ্ত থাকতেন, তাহলে তাদেরকে ঝাঁসীতে অবস্থান করার জন্য প্ররোচিত করতেন।
মেজর আরস্কিন রাণীর আন্তরিকতায় কোনো রকম সন্দেহ করেননি। সেজন্য মধ্যবর্তী সময়ে তার হাতে শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাকে পুলিশ নিয়োগ এবং রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন। ভারতের গভর্ণর জেনারেল শর্তসাপেক্ষে মেজর আরস্কিনের ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ঘোষণা করা হলো, রাণীর বিবৃতি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে রাণীকে রেহাই দেয়া হবে না। ইংরেজরা ঝাঁসীতে ৬০জন পুরুষ, নারী ও শিশু হত্যার ব্যাপারে চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের পক্ষে এ ব্যবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। সারা ভারত জুড়ে সেপাইরা তখন বিদ্রোহ করেছে।
রাণীর শত্রুরাও বসে ছিলো না। গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ভ্রাতুস্পুত্র সদাশিব রাও বার বার সিংহাসন দাবি করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি মনে করলেন, সেপাইরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলে অবশেষে তার ক্ষমতা দখলের সুযোগ এসেছে। তিনি কিছু সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে ঝাঁসী থেকে চল্লিশ মাইল দূরে কারেরা দুর্গ অধিকার করলেন। তারপর সেখান থেকে পুলিশ এবং রাজস্ব কর্মচারিদের তাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি নিকটবর্তী গ্রামসমূহে গোলযোগ করতে থাকেন এবং নিজেকে ঝাঁসীর মহারাজা বলে ঘোষণা করেন। রাণীর সৈন্যরা তাঁকে কারেরা হতে তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু তিনি নরওয়ারের সিন্ধিয়ার রাজত্বে নিরাপদ আশ্রয় পেলেন। সেখানে কিন্তু সৈন্য সংগ্রহ করে আবার লুটতরাজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এবারে রাণীর সৈন্যরা তাঁকে ঝাঁসীর দুর্গে বন্দী করে নিয়ে যায়।
জব্বলপুর বিভাগের কমিশনার রাণীকে নির্দেশ দিয়েছেন, ব্রিটিশ সৈন্য না আসা পর্যন্ত ঝাঁসীর শাসন এবং প্রতিরক্ষার ভার গ্রহণ করতে। তিনি অনুগতভাবে এ কর্তব্য গ্রহণ করলেন। কিন্তু পরে দেখতে পেলেন বিদ্রোহী সেপাইরা নয়, ব্রিটিশের অনুগত ধুন্দেলারাই তাঁর রাজ্য পূর্ব হতে পশ্চিমে আক্রমণ করেছে এবং দুর্গকে বিপন্ন করে তুলেছে। বারবার সাহায্যের আহ্বান করে ব্যর্থ হলেন। এ প্রতিভাময়ী রমণী কিছুতেই ওরচা এবং দাতিয়ার হাতে পরাজয় মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। তিনি সৈন্য সংগ্রহ করলেন, কামান তৈরি করালেন। তার সৈন্যরা মুরানীপুর এবং বারওয়া সাগারে শত্রুদের দু’দুবার পরাজিত করলো। নাথে খান পরাজিত হলো বটে, কিন্তু রাণীও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে অনেক বিদ্রোহী সেপাই চাকুরি গ্রহণ করেছিলো। তার মিত্রদের মধ্যে বনপুর এবং শাহ্পুরের রাজা সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অধীন সামন্তেরা বিজয়ের স্বাদ পেয়ে অধিকতররা বড়ো যুদ্ধ করার বাসনা পোষণ করতে লাগলেন।
৮ই জানুয়ারি তারিখের একটি সংবাদে জানা যায় যে জেল দারোগা করিম বখশ রাণীর কাছে লিখে পাঠিয়েছেন, তিনি ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী আছেন কিনা? রাণী জানালেন, তিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, ইংরেজ সেনাবাহিনী এসে পৌঁছেলে তার অধীনে যতোগুলো জেলা আছে, সবগুলোর কর্তৃত্বভার তিনি ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেবেন। ২৬শে জানুয়ারি তারিখে খবর পাওয়া গেলো, রাণী তাঁর সৈন্যবাহিনীকে মুরানীপুরে ওরচার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন। তারপর তিনি কমিশনারের কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। যদি প্রতিনিধিকে সসম্মানে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ অফিসারেরা তাঁর সঙ্গে বিরূপ ব্যবহার করলে তিনি যুদ্ধ করবেন। বন্দুক এবং বারুদ প্রস্তুত হতে লাগলো। ফেব্রুয়ারি মাসেও রাণী যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যদিও তাঁর প্রস্তুতি চলছিলো। মার্চ মাসে তার সভাসদদের মধ্যে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। কিছু সংখ্যক সভাসদ ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি করতে মত দিলেন এবং কিছু সংখ্যক সভাসদ রাণীকে যুদ্ধ করে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে লাগলেন।
আরো খবর পাওয়া গিয়েছে শাহজাদা ফিরোজ শাহ্ ঝাঁসীতে অবস্থান করছেন। আরেক সংবাদে জানা যায়, তাঁতিয়া টোপী রাণীকে ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি করতে বারণ করেছেন। কিন্তু এ সকল সংবাদের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। জানুয়ারি মাসে তিনি ব্রিটিশ উদাসীনতার কারণে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে পরিস্থিতি অনুসারে নিজের পথ অনুসরণ করেছেন, মার্চ মাসে তার কিছু কিছু সংবাদ মারমুখী নীতি গ্রহণের জন্য রাণীকে প্ররোচিত করেছেন। তিনি পুরনো ব্রিটিশ সেপাইদের সেনাদলে ভর্তি করলেন। তারা ছিলো যুদ্ধের জন্য। শান্তির সময়ে তারা অহেতুক অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে যাহোক, তিনি অতি সাবধানতার সাথে ব্রিটিশ গতিবিধি নিরীক্ষণ করে আসছিলেন। জানুয়ারিতে যে প্রত্যাশা ছিলো, মার্চ মাসে তা অবসিত হয়ে এলো। স্যার হাফরোজ ঝাঁসীর দিকে পথ দিয়েছেন। তাঁর হাবভাব বন্ধুসুলভ মনে হচ্ছে না।