চর্বি মাখানো টোটার কাহিনী অন্যান্য স্থানের মতো নিশ্চিতভাবে ঝাঁসীতেও প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। মে মাসে দিল্লী এবং মীরাটের বিদ্রোহের সংবাদ ক্যাপটেন ডানলফ এবং তাঁর সহকর্মীদের কাছে এসে পৌঁছলো। তাঁরা কোনো রকম গোলযোগের আভাসও পেলেন না। আমানত খানের বর্ণনা মতে, জুন মাসে একজন সেপাইকে মৃত্যুদণ্ড দান করা হলো। স্যার রবার্ট হ্যামিলটন বলেছেন, ‘আমার রেজিমেন্টের কোনো একজন সেপাইয়ের আত্মীয় অথবা চাকর দিল্লী থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছে। সে চিঠির মর্মানুসারে, ‘ঝাঁসীর ঘাঁটিতে বাংলা প্রেসিডেন্সীর যে সকল সেপাই রয়েছে তারা যদি সামগ্রিকভাবে বিদ্রোহ না করে তা হলে জাতিচ্যুত অথবা ধর্মচ্যুত হবে।’ ৫ই জুন বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। সৌভাগ্যবশতঃ আমরা প্রথম দিবসে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পেয়েছি। ঝাঁসীর ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন গর্ডন ৬ তারিখে মেজর আরস্কিন এবং ওয়েস্টার্ণকে লিখেছেন, স্কীনের অনুরোধে কয়েক পংক্তি আমি আপনার কাছে লিখছি। ১২নং রেজিমেন্টের একাংশ ক্যান্টনমেন্টে প্রকাশ্য বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে। যে দুর্গের মধ্যে অস্ত্র ও সাড়ে চার লক্ষ টাকার মতো রাজস্ব জমা ছিলো, সব দখল করে ফেলেছে। তাদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সেপাইরা এসে যোগ দিয়েছে। এখন আমাদের হাতে রয়েছে মাত্র দু’টি কামান। তারা কিভাবে এসব করতে সমর্থ হয়েছে, নিম্নে তা বলছি। গতকাল বেলা ৩টার সময় সেপাইদের মধ্যে শোরগোল উঠলো যে ডাকাতেরা অস্ত্রাগার আক্রমণ করেছে এবং তারা দ্রুত সেদিকে ধাওয়া করলো। বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত নয় এমন কতিপয় সেপাই গুলি ভর্তি বন্দুকসহ অবস্থান নিয়ে নিলো। তারপরে বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায় কিন্তু সন্ধ্যার সময় তারা সদলবলে আবার আগমন করে। দু’টি কামান এবং ৫০ জন সেপাইয়ের সাহায্যে অস্ত্রাগার আমরা তখনো রক্ষা করে আসছিলাম। আমরা নিশ্চিত যে সেপাইদের এবং গোলন্দাজদের মধ্যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। আমি ঠাকুরদের সাহায্যে বিদ্রোহীদের দুর্গ থেকে বের করে দিতে পারি, কিন্তু সকলে প্রথমবার গুলি ছোঁড়ার পরেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেবে। আমরা আরো জানতে পেরেছি ঠাকুরেরা বেশ হৃষ্টচিত্তেই ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাব করেছিলো। অনেক সাহায্য তাদের কাছ থেকে নেয়াও হয়েছে। ধুলোর সাহায্য চেয়ে গোয়ালিয়র এবং কানপুরে সংবাদ পাঠানো হলো। আরস্কিন এবং ফোর্ড সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় এবং খ্রীস্টানদের পরিবার-পরিজনসহ দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তাঁরা ভালোভাবে জানতেন যে এখন কোনো দিক থেকে সাহায্যের আশা করতে পারেন না এবং নিজেদের যা আছে তাই দিয়েই আত্মরক্ষা করতে হবে।
ক্যাপটেন ডানলপ এবং অন্যান্য সামরিক অফিসারেরা তখনো আশা পোষণ করছেন যে তাঁরা সেপাইদের শান্ত রাখতে পারবেন এবং সেজন্য তারা তখনো সেপাই লাইনে শয়ন করেন। ৬ তারিখে জেল দারোগা সেপাই-সান্ত্রীসহ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ক্যাপটেন ডানলপকে হত্যা করেন। যারা ব্রিটিশ পক্ষ নিয়েছিলো, সে সকল সেপাইদেরও হত্যা বা জখম করা হলো। ১৪নং গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ক্যাম্পবেল আহত হন। চারদিক থেকে দুর্গ ঘেরাও করে রাখা হলো। তিনজন ছদ্মবেশে দুর্গের বাইরে যেতে চেষ্টা করে ধৃত হলো এবং তাদেরকে হত্যা করা হলো। ৮ তারিখে ক্যাপটেন গর্ডন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন অথবা হতাশায় আত্মহত্যা করেন। লেফটেন্যান্ট পাওরিস দুর্গের অভ্যন্তরেই একজন ভারতীয় চাকরের হাতে নিহত হলেন। দ্বি-প্রহরের দিকে নিরাপত্তার শর্তে অথবা কোনো রকম শর্ত ছাড়াই দুর্গ থেকে সকলে বেরিয়ে এলেন। শিশু, মহিলাসহ দলের সমস্ত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। মৃতদেহগুলো স্থূপাকারে জোখানবাগে রাখা হয়েছিলো এবং সকলকে একটি মাত্র গর্তে চাপা দেয়া হয়। জেল দারোগা করিম বখশ এই নৃশংস হত্যার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দুটি সন্তানসহ একটি মহিলা মাত্র হত্যাকারীদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্যার রবার্ট হ্যামিল্টন যিনি এক বছর পরেও এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করেছিলেন, তিনিও স্পষ্টভাবে রাণীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের কোনো সংযোগ আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। আমরা আগেই ১২নং রেজিমেন্টের মত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সেপাইটির কথা উল্লেখ করেছি। তাকেই তিনি দায়ী করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, বিদ্রোহীরা যে সকল সেপাই বিদ্রোহে অংশ নিতে রাজী ছিলো না, তাদেরকে বন্দুকের মুখে বিদ্রোহে অংশ। নিতে বাধ্য করেছে। তারপরে বিদ্রোহীরা সকলে রাণীর প্রাসাদে গমন করে গুলি ভর্তি বন্দুকসহ রাণীর কাছ থেকে সাহায্য এবং রসদ দাবি করে। তিনি সেপাইদেরকে খুশী মনে রসদ, অস্ত্রশস্ত্র এবং আরো নানা প্রকারে সাহায্য করেন।
এ বর্ণনার সঙ্গে কমিশনার এবং এজেন্ট মেজর ডরু. সি. আরস্কিনের কাছে চিঠিতে বিদ্রোহের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, রাণীর কাছ থেকে প্রচুর টাকা-পয়সা আদায় করে ১২ তারিখে সেপাইরা দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে। সেদিনই ডাকহরকরা আরস্কিনকে একখানা পত্র দিয়ে যায়। দু’দিন পরে ডাকহরকরা ঝাঁসীর ঘটনার আনুপূর্বিক বৃত্তান্তসহ আরেকখানা পত্র তার সাক্ষাতে উপস্থিত করে। রাণী লিখেছেন, ঘাঁটিতে যে সকল সরকারি সেপাই রয়েছে তারা ধর্মহীন, নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁসীর সমস্ত সামরিক বেসামরিক ইউরোপীয় অধিবাসীদের হত্যা করেছে। কেরাণীকূল এবং তাঁদের পরিবারবর্গ কেউই রক্ষা পায়নি। কামানের অভাববশতঃ রাণী তাঁদের কোনো রকমের সাহায্য করতে পারেননি। তাঁর মাত্র ৫০ থেকে ১০০ জন সৈন্য ছিলো। তার প্রাসাদ পাহারা দেয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন। সে কারণে তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেননি। এজন্য তার আফসোসের অন্ত নেই। তারপরে বিদ্রোহী সেপাইরা তাঁর বিরুদ্ধেও প্রচুর ধ্বংসাত্মক কাজ করছে, চাকর-বাকরদের উপর নির্যাতন করেছে এবং তাঁর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ছিনিয়ে তারা দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছে। যেহেতু রাণী শাসন করার একমাত্র দাবিদার, তাই সেপাইরা যখন সম্রাটের কাছে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছে, এ সময়ে শাসনকার্য তার ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। রাণীর যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল সেপাইদের দ্বারা সংঘটিত এতো বড়ো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর তিনি ঝাঁসীর তহশীলদারের সাহায্যে ডেপুটি কমিশনারের বিচার বিভাগীয় সেরেস্তাদার এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টের কোর্টে সংবাদ প্রেরণ করছেন। রাণী যদি সেপাইদের অনুরোধে রাজী না হন, তাহলে তারা রাণীর প্রাসাদ উড়িয়ে দেবে। তাঁর মান-সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি সেপাইদের অনেক অনুরোধ রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক সম্পদ এবং নগদ টাকা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সমগ্র জেলার মধ্যে একজন ব্রিটিশ অফিসারও জীবিত নেই জেনে তিনি জেলার প্রত্যেকটি সরকারি কর্মচারির কাছে পরোয়ানা পাঠিয়েছেন, যাতে তারা কর্মস্থলে থেকে কর্তব্য কর্ম করে যায়। বার বার তাঁকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এটা ঠিক যে এ সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো উচিত ছিলো। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি যে সকল লোক, তারা তাঁকে সে রকমের কোনো সুযোগ দান করেননি। সেপাইরা দিল্লীর দিকে পথ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পত্র লিখতে বসেছেন। ১৪ই জুলাই তারিখে এ পত্র লিখেছিলেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, সমগ্র জেলাতে অরাজকতার রাজত্ব চলছে। প্রতাপশালী সামন্তেরা দুর্গগুলো অধিকার করে নিয়ে আশেপাশে নির্যাতন এবং লুণ্ঠনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। জেলার নিরাপত্তা রক্ষা করা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। কারণ এ জন্য অর্থের প্রয়োজন। এ অবস্থায় কোনো মহাজন তাঁকে অর্থ ঋণ দিতে রাজী হবে না। বর্তমান সময় পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রয় করে প্রচুর অসুবিধার সম্মুখীন হয়েও লুটেরাদের হাত থেকে নগর রক্ষা করে আসছেন। শহর এবং মফঃস্বলের ঘাঁটির অনেক কর্মচারিকে তিনি আশ্রয়দান করেছেন, কিন্তু উপযুক্ত সরকারি শক্তি এবং অর্থের অভাবে তা দীর্ঘদিন রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং জেলার প্রকৃত অবস্থা লিখে জানালেন, বিশ্বাস মতো তাঁর ওপর যে আদেশ জারী করা হবে সে অনুসারেই তিনি কাজ করবেন।