১৮৫৩ সালে তার কোনো পুত্রসন্তান না রেখে তিনি মারা গেলেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বের দিন তার সভাসদবৃন্দ ঝাঁসীর ব্রিটিশ রাজনৈতিক এজেন্ট মেজর এলিস, ঝাঁসী বাহিনীর সামরিক প্রধান ক্যাপটেন মার্টিনের সামনে নাভালকর পরিবারের একটি ছেলেকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি মেজর এলিসকে অনুরোধ করলেন ব্রিটিশ সরকার যেন তাঁর বিধবা পত্নী এবং পুত্রের হাতে শাসনভার অর্পণ করেন। গভর্ণর জেনারেলের কাছে যে মানচিত্র পাঠানো হয়েছিলো, তাতে রাণীমাতা দাতিয়া, ওরচা ইত্যাদি বুন্দেল রাজ্যে দত্তক পুত্রের অধিকার স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। মেজর এলিসও বিধবা রাণীকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু গভর্ণর জেনারেলের এজেন্ট ম্যালকম এ সম্পর্কে ভিন্নতরো ধারণা পোষণ করতেন।
গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর সময়ে লর্ড ডালহৌসী কলকাতার বাইরে ছিলেন, সুতরাং রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সে মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সে যাই হোক, লর্ড ডালহৌসী রায় দিলেন ঝাসীকে ব্রিটিশ শাসনাধীনে নিয়ে এলেই প্রজাদের সুবিধা হবে। ১৮৫৪ সালে ঝাসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। রাণীর জন্য ভাতা মঞ্জুর করা হলো যাবজ্জীবন এবং তাঁকে রাজপ্রাসাদে বাস করার অনুমতি দেয়া হলো। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ বিচারালয়ের আওতামুক্ত থাকার অধিকারও দেয়া হলো। এমন কি দত্তক পুত্র গ্রহণেও কোনো বাধা দেয়া হলো না। দামোদর রাওকে পারিবারিক ঐশ্বর্যের এবং তাঁর বাবার ব্যক্তিগত সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হলো।
গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর রাজকোষ অনুসন্ধান করে দেখা গেলো ৬ লক্ষ টাকা রাজকোষে সঞ্চিত রয়েছে। এ সমস্ত টাকা ভারত সরকারের কাছে গচ্ছিত ছিলো, এ শর্তে যে সরকার অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজপুত্রের আমানতদারী করবেন। সচরাচর যেমন হয়ে থাকে, সরকার ভারতীয় জনসাধারণের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বসলো। নাবালকের বংশের পারিবারিক বিগ্রহ মহালক্ষ্মীর মন্দিরের ব্যয়ভার বহনের জন্য যে সকল গ্রাম নির্দিষ্ট করে রাখা ছিলো সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিলো। রাণী প্রথমে ভাতা গ্রহণ করতে রাজী হননি। কিন্তু গঙ্গাধর রাওয়ের আত্মীয়-স্বজনের প্রতিপালন এবং ঋণ শোধ করার জন্য ভাতা গ্রহণ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো পন্থা রইলো না। সরকার ঝাঁসীর মতো ব্রাহ্মণ রাজ্যে গো-হত্যার প্রবর্তন করাতে তিনি সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হলেন।
রাণীর সঞ্চিত ৬ লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা গঙ্গাধর রাওয়ের পবিত্র শ্রাদ্ধের কাজে বরাদ্দ করে সরকারের কাছে টাকার জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু সরকার চারজন জামিনদার ছাড়া টাকা দিতে রাজী হলো না। সরকারের পক্ষে যুক্তি হলো, নাবালক রাজপুত্র যদি সাবালক হয়ে এ টাকা দাবি করে, জমিদার চারজনকেই সে টাকা পরিশোধ করতে হবে। রাণী তখনও আশা করেছিলেন, অন্যান্য রাজ্যহারা রাজপুরুষদের বেলায় যেমন হয়েছে, তেমনি যদি ডিরেকটরদের সভায় তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, তাহলে তাঁর ছেলের উপর অবশ্যই সুবিচার করা হবে । সুতরাং তিনি বিলাতে প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। তাতে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হলো, কিন্তু ডিরেকটর সভা গভর্ণর জেনারেলের সিদ্ধান্তের কোনো অদল-বদল করলেন না। সে কারণে এবং ঝাঁসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্তির ফলে জনসাধারণের মনে সন্দেহ দেখা দিলো।
রাণী লক্ষ্মীবাই ছিলেন গরীব পিতামাতার মেয়ে। রাণীর পিতা মহরাপন্থ তসবে চিমনজী আপ্পার দেহরক্ষী ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে বেনারসে থাকতেন। রাণীর বাল্যনাম ছিলো মনিকর্ণিকা। স্বামীর ঘরে এসেই তিনি লক্ষ্মীবাই নামে পরিচিত হন। তাঁর বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিদ্রোহের পরে তার সম্বন্ধে নানা গল্প-কাহিনী এবং গুজব সৃষ্টি হয়। স্বামীর তুলনায় তিনি অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী ছিলেন। প্রথম রাণীর মৃত্যুর পর গঙ্গাধর রাওয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জন লেং নামে যে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবি ঝাঁসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, তিনি তাঁর সম্বন্ধে কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন নাতিদীর্ঘ মহিলা, একটু স্কুলাঙ্গী, তবে অধিক নয়। যৌবনে নিশ্চয়ই তাঁর মুখখানা অত্যন্ত সুন্দর ছিলো। এখনো সে মুখের আকর্ষণ কম নয়। মুখাবয়বটিও সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত। বিশেষ করে চোখ দুটি টানা টানা, নাকটা টিকালো। তাঁর গাত্রবর্ণ ফর্সা না হলেও কিছুতেই তাকে কৃষ্ণাঙ্গী বলা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য, একজোড়া ইয়ারিং ছাড়া তার শরীরে আর কোনো অলংকার নেই। তিনি সাদাসিধে মসলিনের শাড়ি পরিধান করেছিলেন। সে শাড়ি এতো মিহি, এতো সূক্ষ্ম যে তাঁর শরীর অন্তরাল থেকে আভাসিত হয়ে উঠেছিলো। তিনি অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা ছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্কশ কণ্ঠস্বর সৌন্দর্যকে অনেকাংশে ম্লান করে দিয়েছে। মেজর এলিস ঝাঁসীর অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘মেরে ঝাঁসী নেহি দেওঙ্গী।’ এটা সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ না কি আবেগের ক্ষণিকের প্রকাশ বলা মুশকিল। কিন্তু ঝাসীকে ভারত সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। রাণী নীরবে স্বামীর প্রাসাদ ছেড়ে তার জন্য নির্ধারিত প্রাসাদে চলে গেলেন। সেখানে তিনি হিন্দু বিধবার মতো জীবনযাপন করতে লাগলেন। তাঁর সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হলো। ১২নং বাঙালি পল্টন কেল্লার মধ্যে ছাউনি ফেললো। সবকিছুই শান্তিপূর্ণভাবে চলছিলো। নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। ক্যাপটেন আলেকজান্ডার স্কীনকে পলিটিক্যাল অফিসার এবং ক্যাপটেন ডানলপকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হলো।