এবারে কুমার সিং তাঁর জগদীশপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের দিকে পথ দিলেন। বুড়ো সিং এবার সত্যি তাঁর মরণ ফাঁদে পা বাড়ালেন। গঙ্গা পার হওয়ার সময় কামানের গোলার আঘাতে তার একখানা হাত একেবারে ভেঙ্গে গেলো। কথিত আছে, বুড়ো রাজপুত ধারালো তরবারির সাহায্যে তাঁর বিক্ষত বাহু কেটে গঙ্গার পবিত্র জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিনা বাধায় অগ্রসর হতে পারছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিলো খুব বেশি হলে মাত্র দু’হাজার মানুষ। তারা অভুক্ত, ক্লান্ত, আহত-সঙ্গে একটি বন্দুকও নেই। আবার ক্যাপটেন লি গ্র্যান্ড মেজর আয়ারের মতো জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আহত সিং আক্রমণের পর আক্রমণ করে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। লি গ্র্যান্ড সৈন্যদের মধ্যে কেবলমাত্র শিখেরাই কিঞ্চিৎ শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিলো। ইউরোপীয় সৈন্যরা সম্পূর্ণরূপে ছন্নছাড়া হয়ে পড়লো। তাদের বিস্তর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। লি গ্র্যান্ড এবং অন্য দু’জন অফিসার মারা গেলেন। ৩০নং রেজিমেন্টে ১৫০জন সৈন্যের মধ্যে ১০০জন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২৩শে এপ্রিল লি গ্র্যান্ডের সৈন্যরা পরাজিত হলো এবং ২৪ তারিখে কুমার সিং মারা গেলেন। একটি মহান জীবনের অবসান ঘটলো।
কুমার সিংয়ের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর ভ্রাতা অমর সিং সৈন্যদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। কোনো সামরিক প্রতিভা না থাকলেও রাজপুত পূর্ব পুরুষের দৃঢ়তা এবং সাহস তার মধ্যে ছিলো। তাঁর প্রজাদের আস্থাভাজন হয়ে তিনি শাহবাদে একটা সরকার গঠন করেন, বিচারক এবং উসুলকারক নিয়োগ করলেন। ব্রিটিশ সরকার যেমন তাঁর মস্তকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, তিনিও তেমনি ব্রিটিশ সরকারের প্রধানের মস্তকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন।
এখন অমর সিং ভয়ানক বিপদের সম্মুখীন হলেন। তিনটি ব্রিটিশ সৈন্যদল এখন আরাতে এসে মিলিত হয়েছে। ডগলাস এসেছেন শোন নদী পার হয়ে দানাপুর থেকে। স্যার এডওয়ার্ড ন্যুগার্ড এসেছেন আমগড় থেকে এবং কর্ণেল করফিল্ড সাসারাম থেকে। এখন অমর সিংয়ের সৈন্য সংখ্যা দু’হাজার থেকে আড়াই হাজার। তার মধ্যে অশ্বারোহীর সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০ জন। সম্মুখ যুদ্ধে রাজপুত জমিদারদের জয়লাভ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং অমর সিং জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করে গ্যারিলা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্থির করলেন। জগদীশপুর ব্রিটিশ দখলে চলে গেলে অমর সিং লাতাওয়ারপুরে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। গার্ড জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অভিযান করে শত্রুদের শায়েস্তা করতে চাইলেন। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সুবিধা করতে পারলেন না। স্বাস্থ্য খারাপের অজুহাতে তিনি অধিনায়কের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে বিদ্রোহীরা ইংরেজদের অনুগত জমিদারদের আক্রমণ করে শাস্তি দিলেন। জুন মাসে অমর সিং গঙ্গার অপর তীরের ঘুরমার নামক স্থানে উপনীত হলেন। খবর রটলো তিনি অযোধ্যা যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। গাজীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ভয় করতে লাগলেন যে তাঁর ঘাঁটি আক্রান্ত হবে এবং গাবিনস্ ভয় করতে লাগলেন রাজপুত প্রধান বেনারস আক্রমণ করবেন। ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে তাঁরা আরা আক্রমণ করে শহরের উপকণ্ঠে মিঃ ভিক্টরের বাঙলো জ্বালিয়ে দিলো। বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করা হলো, তারা অমর সিংয়ের গ্রামে আশ্রয় নিলেন। আবার ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ কর্ণেল ওয়াল্টারম্যান খবর পেলেন বিদ্রোহীরা শহরের বারো মাইল পশ্চিমে এসে পড়েছে। তারপরে তিনি পলায়ন করলেন, কিন্তু তাদের ঘাঁটি রক্ষা পেয়ে গেলো। পরের দিন ওয়াল্টার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চিঠি পেলেন যে বিদ্রোহীরা শহরের কাছে এসে পড়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্য আসবার আগেই তারা পঁচিশটা ঘর এবং দোকানপাট লুটপাট করে ফেলেছে। প্রত্যাবর্তনের সময় তারা ইংরেজের অনুগত জমিদার চৌধুরী প্রতাপ নারায়ণ সিংয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলেন। পরের দিন পঞ্চাশ জন সেপাইয়ের একটি ক্ষুদ্র দল পুনরায় আরার উপর হামলা করলো। একটি দল গয়া আক্রমণ করে কারাগারের দরোজা খুলে দিলো। ডগলাস জঙ্গল বেষ্টন করে বিদ্রোহীদেরকে ধরতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের মতো তাড়াতাড়ি তারা চলাফেরা করতে পারতেন না। তরুণ হ্যাভলকের পরামর্শে ডগলাস পার্বত্য পদাতিক বাহিনী নিয়োগ করলেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। তারা অধিকতর যোগ্যতার পরিচয় দিলো। বিদ্রোহী বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো, কিন্তু তাঁদের নেতা কাইমুর উপত্যকায় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ১৮৫৮ সালে ডগলাস তাকে সেখানে অক্রমণ করলেন। এভাবে পশ্চিম বিহার অভিযান শেষ হয়ে এলো। অমর সিং এবারেও গা ঢাকা দিলেন।
নিশান সিং ধৃত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিলেন। হরকিষাণ সিংকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। অমর সিংয়ের সেনাদল নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। কিন্তু কিছুতেই অমর সিংকে পরাজিত করা সম্ভব হলো না। ১৮৫৮ সালে কর্ণেল রামজে শুনতে পেলেন জগদীশপুরে অমর সিং তেরাইয়ের সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। বিহারের ভূস্বামীগণ সব সময় ব্রিটিশকে সাহায্য করেছে। শাহবাদের সিংয়েরা যে শৌর্য-বীর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
৭. ‘মেরে ঝাঁসী নেহী দেওঙ্গী’
বুন্দেলখণ্ডের মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র মারাঠা সর্দারের রাজ্য হলো ঝাঁসী। পেশবার সময়ে এ সুবা প্রদেশ বলে পরিচিতি ছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকার প্রদেশটিকে আলাদা একটি রাজ্যের গৌরবে উন্নীত করেন। বুন্দেল রাজা ছত্রশাল মুসলমানদের বিরুদ্ধে সময় মতো সাহায্য করার জন্য প্রথম বাজীরাওকে তাঁর রাজ্যের তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দেন। পেশবা তার শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বুন্দেলখণ্ডকে তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। প্রথম অংশের শাসনভার গোবিন্দ পান্থ খেরের হাতে অর্পণ করেন। তার সদর দফতর ছিলো সাগার। দ্বিতীয় অংশে ছিলো বান্দা এবং কল্পি। অবৈধ সন্তান শমসের বাহাদুরকে এ অংশের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। তৃতীয় অংশ ঝাঁসীর শাসনকতার পদ রঘুনাথ হরি নাভালকরের পরিবারে চিরস্থায়ী হয়ে যায়। তিনি তাঁর ভ্রাতা শিবরাম ভাওকে শাসনভার ছেড়ে দিয়ে ১৮০৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮১৭ সালে শিবরাম ভাওয়ের উত্তরাধিকারী এবং দৌহিত্র রামচন্দ্র রাওয়ের মধ্যে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুসারে রামচন্দ্র রাওকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়। ১৮৩৫ সালে তাঁকে মহারাজাধিরাজ ফিদভী বাদশাহ্ জমিয়া ইংলিশস্থান উপাধি দেয়া হয়। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিলো না। তাঁর বিধবা পত্নী কৃষ্ণরাও নামে তার এক বোনের ছেলেকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। যেহেতু প্রচলিত প্রথা অনুসারে অন্য পরিবারের সন্তানকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা চলে না, সেহেতু রামচন্দ্র রাওয়ের কাকা রঘুনাথ রাওয়ের সিংহাসনে আরোহণের স্বপক্ষে ব্রিটিশ সরকার মত দিলেন। রঘুনাথ রাও ছিলেন একেবারে হঠকারী প্রকৃতির লোক। তাঁর কুশাসনে রাজ্য রসাতলে যাবার উপক্রম হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার এ অজুহাতে রাজ্যভার পরিচালনা নিয়ে নিলেন। রঘুনাথ রাও আইনতঃ কোনো উত্তরাধিকারী না রেখেই মারা গেলেন। তাঁর অবৈধ সন্তানত্রয় কৃষ্ণরাও, রামচন্দ্র রাও এবং রাজার ভ্রাতা গঙ্গাধর রাওয়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার গঙ্গাধর রাওকেই সমর্থন করেন। কিন্তু ১৮৪৩ সালের আগে তাঁর হাতেও শাসনভার দেয়া হলো না। তিনি চমৎকার একখানা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করলেন এবং শহরের উন্নয়ন সাধন করলেন।