কুমার সিংকে কখন পাটনাতে আহ্বান করা হয়েছিলো আমাদের পক্ষে তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। সম্ভবত জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে। ওহাবী নেতৃবৃন্দ মিঃ টেইলারের সঙ্গে জুনের ২ তারিখে তার আমন্ত্রণক্রমে দেখা করেছিলেন এবং তাদেরকে অন্তরীণ করা হয়েছিলো। সন্দেহভাজন দাঙ্গাকারীদেরকে জুলাই মাসে ইতর-বিশেষ প্রভেদ না করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিলো। ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েক কুমার সিং-এর গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন, কিন্তু তার প্রতীতি জন্মালো যে বিদ্রোহ বিক্ষোভ কিছু ঘটলে প্রজারা বৃদ্ধ সামন্তকেই সবান্তঃকরণে সমর্থন করবে।
কুমারের প্রধান সহকারীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর ভ্রাতা অমর সিং, ভাইপো রীতভঞ্জন সিং, তহশীলদার হরকিষাণ সিং এবং ষাট বছরের বুড়ো তাঁর বন্ধু নিশান সিং। দিলওয়ার খান এবং সারনাক সিংয়ের নামও উল্লেখ করা যেতে পারে।
সেপাইরা রাজকোষ লুঠ করে ফেললো। কয়েদখানা ভেঙ্গে কয়েদীদেরকে মুক্তিদান করলো। কুমার সিংয়ের কাছে ছিলো দু’টো কামান, কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে এলো না। শিখেরা ছিলো ব্রিটিশদের প্রধান রক্ষাকর্তা। জনৈক ব্রিটিশ অফিসার মন্তব্য করেছেন, আমাদের সঙ্গে যদি শিখেরা না থাকতো, তাহলে সেপাইরা প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের শেষ করে দিতো। শিখদের পক্ষে হুকমত সিংহ অবরোধকারী সেপাইদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে শৌর্য-বীর্য এবং বীরত্বের পরিচয় দান করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। ৩১ তারিখ জুলাইয়ে মেজর ভিনসেন্ট আয়ার না আসা পর্যন্ত শিখেরা অপরিসীম বীরত্ব সহকারে ইউরোপীয়দের রক্ষা করে। তিনি এলে অবরোধকারীরা চলে যেতে বাধ্য হয়।
মেজর আয়ার আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপরে তিনি ব্রহ্মদেশে ছিলেন। বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের পরে তিনি ভারতে আসেন। সে যাহোক তিনি বক্সার থেকে আরা অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে তিনি ডানবারের পরাজয়ের খবর পেলেন। সেপাইরা পথে তাকেও বাধা দিলেন। কিন্তু ভারী কামানের অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে রাইফেলধারী সেপাইরা হটে যেতে বাধ্য হয়। আবার কুমার সিং বিবিগঞ্জে তাঁর অগ্রগতি রোধ করে দাঁড়ালেন। কিন্তু দৃঢ় আক্রমণের মুখে তার সৈন্যেরা কোনোরকম সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না। সঙ্গিনের সাহায্যে ২রা আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও কুমার সিংয়ের পক্ষে আরা রক্ষা করা সম্ভব হলো না। সুতরাং মেজর আয়ার আরামে মুক্ত করে ফেললেন।
আরা থেকে কুমার সিং তাঁর পৈতৃক দুর্গ জগদীশপুর চলে গেলেন। সেখানেও মেজর আয়ার তার পিছু পিছু ধাওয়া করলেন। প্রাণপণে বাধা দেয়া হলো, কিন্তু ভারী কামানের গোলা বর্ষণের মুখে রাইফেলধারী সেপাইরা দাঁড়াতে পারলো না। কেউ রেহাই পেলো না। আহত সেপাইদের সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে কুমার সিং যে নতুন মন্দির নির্মাণ করেছেন, ভেঙ্গে তা চুরমার করা হলো। কারণ ব্রাহ্মণেরা বিদ্রোহের প্ররোচনা দিয়েছিলো বলে গুজব রটেছিলো। জগদীশপুর প্রাসাদ এবং অন্যান্য অট্টালিকা ধ্বংস করে দেয়া হলো।
কুমার সিংয়ের সেপাইরা পরাজিত হয়েছে, প্রাসাদ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তা সত্য, তবু বুড়ো সিংহকে ধরা এতো সহজ নয়। জগদীশপুরের জঙ্গল থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি রোহতাস পাহাড়ের দিকে গমন করলেন। সেখানে গেলে গ্র্যান্ড রোডে ব্রিটিশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কিন্তু কুমার সিংয়ের পরিকল্পনা ছিলো আরো ব্যাপক। তিনি সঠিক ধারণা পোষণ করেছিলেন যে নিম্নাঞ্চলের প্রদেশসমূহের জয়-পরাজয়ের উপরই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে। রেওয়া, মীর্জাপুর ইত্যাদি অঞ্চলে গমন করে তিনি দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করলেন যে সময়ে তাঁর সঙ্গে মাত্র পাঁচশ অনুগামী ছিলো। আর সকলে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করেছে। ইতিমধ্যে দিল্লীর পতন ঘটলো এবং কুমার সিংকে তাঁর পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হলো।
অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরির পর ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমার সিং লখনৌ এবং দরিয়াবাদের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করেছিলেন। মার্চ মাসে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠলেন। এতোদিন ধরে গুর্খারা আজমগড় থেকে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত করছিলো, কিন্তু তারা লখনৌতে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে যোগ দিতে গমন করলে নগরী অরক্ষিত হয়ে পড়লো, তা কিন্তু কুমার সিংয়ের শ্যেনদৃষ্টি এড়ালো না। তিনি আজমগড় থেকে বিশ মাইল দূরে আডাউলী গ্রাম আক্রমণ করলেন। কর্ণেল মিলম্যান, যিনি ঘাঁটি রক্ষা করছিলেন, তাঁকে পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে হলো। তারপর তিনি আজমগড় আক্রমণ করলেন। কর্ণেল ডেমস এলেন গাজীপুর থেকে মিলম্যানের সাহায্যার্থে। তিনিও পরাজিত হলেন এবং পলায়ন করলেন। পর পর দু’বার ব্রিটিশ পরাজয়ের সংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে লোকচক্ষে ব্রিটিশ মর্যাদা অনেকটা নেমে গেলো। লর্ড ম্যাককারকে সঙ্গে সঙ্গে আজমগড় উদ্ধার করার জন্য পাঠানো হলো। তিনি নগরী পুনরায় দখল করে নিলেন এবং অল্পদিন পরেই তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিলেন স্যার এডওয়ার্ড ন্যুগার্ড। উভয়ের মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কুমার সিংয়ের করার মতো কিছু ছিলো না। তিনি আপন প্রদেশ বিহারে চলে যেতে মনস্থ করলেন। এ সময়ে তিনি বীরত্বপূর্ণ কতকগুলো সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এভাবে তিনি শিবপুর ঘাটে এসে কতেক নৌকা যোগাড় করলেন। এ সময়ে একটা খবর রটলো যে নৌকা কম হওয়ায় তিনি হাতীর পিঠে চড়ে নদী অতিক্রম করতে মনস্থ করেছেন। কিন্তু জেনারেল ডগলাস সে স্থানে পৌঁছোবার পূর্বে দু’শ সৈন্যের বেশি নদী পার হতে পারলো না।