স্বভাবতঃই লয়েড এরকম একটি ভয়ঙ্কর উদ্যোগ গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২৪শে জুলাই তারিখে তাঁকে মনস্থির করতে হলো। দৃঢ়তার অভাবের জন্য তাঁকে নানা রকম উপায় অবলম্বন করতে হলো। যদি তিনটি রেজিমেন্টকে প্যারেডে আহ্বান করে ব্রিটিশ বন্দুকের মুখে অস্ত্র ত্যাগ করতে নির্দেশ দেয়া হতো, তাহলে কয়েকজন ছাড়া আর সকলেই সে আদেশ মেনে নিতো। যে কোনো রকমের বাধাকে বল প্রয়োগে দমন করা যেতো। লয়েড বন্দুকের ক্যাপ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করলেন এবং তার ফলে আগ্নেয়াস্ত্র অকেজো হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করলেন। পরদিন সকালে ব্যারাকের চত্বরে ইউরোপীয় সৈন্যদের আনা হলো এবং বন্দুকের ক্যাপ সংগ্রহ করার জন্য দুখানি গরুর গাড়ি আনা হলো। গাড়িগুলো ফেরত যাওয়ার সময় আতঙ্কিত ৭ এবং ৮নং রেজিমেন্টের সেপাইরা থামাতে চেষ্টা করে এবং তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সে যাহোক অফিসারেরা সেপাইদের মধ্যে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
লয়েডের কাজ এখনো অর্ধসমাপ্ত মাত্র। কারণ এখনো পনেরোটি করে বন্দুকের ক্যাপ রয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন ফেরত চাওয়া মাত্রই সেপাইরা ক্যাপ দিয়ে দেবে। তিনি কাজটি দেশীয় অফিসারদের দ্বারা করাবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু সেপাইরা যখন ক্যাপ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করলো, ইউরোপীয় অফিসারদের আর করার কিছুই রইলো না। অফিসারদের চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো। বলা হয়ে থাকে তাদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়েছিলো। তার ফলে মহারাণীর ১০নং বাহিনীর ইউরোপীয় সৈন্যরা ঘটনাস্থলে আসে এবং সেপাইদের উপর গুলি চালিয়ে কয়েক ডজনকে হত্যা করে। প্রথমে ৪০নং স্বদেশী রেজিমেন্ট বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়নি, কিন্তু হাসপাতালের ছাদ হতে ১০নং ইউরোপীয় রেজিমেন্ট কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তারাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। গোলযোগের সময়ে স্টীমারে নদীবক্ষে ছিলেন টেইলার। অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় সামরিক অফিসারেরা তাঁর প্রয়াজনীয় সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন। বিদ্রোহীদের দমন করার কোনো সুযোগ না দেয়ায় তারা দ্রুত শাহবাদ জেলার সদর দফতর আরাতে চলে গেলেন। তাঁদের স্ত্রী পুত্র-পরিজন সকলেই পেছনে রয়ে গেলেন।
লয়েড নৌকা করে তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের স্টীমারে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কয়েকখানা নৌকা ডুবিয়ে দিলো বিদ্রোহীরা। অগত্যা তাদের আর কোনো পন্থা ভোলা রইলো না। তা ছাড়াও তাদের গন্তব্য যে কোথায় সে সম্বন্ধেও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। তারা আরাতে যেতে পারতেন এবং পাটনা থেকে বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতেন অথবা তারা গয়ার দিকে অগ্রসর হতে পারতেন। পাটনা রক্ষা করাই এখন তাঁর অব্যবহিত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি কামানসহ কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে পাঠানো হয়েছে। ২৬ তারিখে অল্প সংখ্যক রাইফেলধারী সৈন্যসহ একখানি স্টীমার নদীতে ভাসানো হলো। নদীবক্ষ অগভীর ছিলো বলে স্টীমারখানা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারলো না। আরেকখানি ষ্টীমার আরাতে বেসামরিক কর্মচারিদের বয়ে আনতে পাঠানো হয়েছিলো, কিন্তু সেখানে বালুচরে আটকা পড়লো। তৃতীয় স্টীমারখানা এলাহাবাদ থেকে কলকাতাগামী যাত্রী বহন করে বিকেল বেলা পৌঁছেছিলো। এ স্টীমারখানা রিকুইজিশন করা হয়েছিলো, তাঁদের বয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ক্যাপটেন ঘুমন্ত যাত্রীদের বিরক্ত করতে রাজী না হওয়ায় তাতে অনেক সময় লেগে গেলো। তাই ২৯ তারিখে বিকেল বেলাতেই মাত্র অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপটেন ডানবারকে পাঠানো সম্ভব হয়েছিলো।
অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেলো। জগদীশপুরে বাবু কুমার সিং সেপাইদের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি রাত্রিবেলা আক্রমণ করে ব্রিটিশ সৈন্যদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলেন। অর্ধেক মানুষ নিহত হলো। তার ফলে পাটনা এবং অন্যান্য জেলায় অফিসারেরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। এ শোচনীয় ঘটনার পরে টেইলারকে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলাতে বদলি করা হলো।
লখনৌতে হঠাৎ করে বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। টেইলার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়েককে সাবধান করে বলেছিলেন, “আরার সেপাইরাও যে বিদ্রোহ করতে পারে তা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে।” একটি অধিবেশনে স্থির করা হলো মহিলা এবং শিশুদেরকে দানাপুরে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার মিঃ বয়লারের বাসগৃহে স্থান দেয়া হবে, যেখানে চরমতম বিপদের মুহূর্তে পুরুষ মানুষেরাও আশ্রয় গ্রহণ করবে। অল্প সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র সংগ্রহ করা হলো। কিন্তু বেসামরিক অফিসারেরা সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করা নিরাপদ জ্ঞান করলেন না। দু’জন ছাড়া আর সকলেই অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ২৬শে জুলাই একজন অশ্বারোহী সেপাই সংবাদ নিয়ে এলো যে সেপাইরা শোন নদী অতিক্রম করেছে। পনেরো জন ইউরোপীয় এবং পঞ্চাশ জন শিখ সৈন্য আরাতে মিঃ বয়লারের বাসগৃহ পাহারা দিতে গেলেন। ২৭ তারিখে বিদ্রোহীরা কুমার সিংয়ের ঝান্ডার তলায় সমবেত হলেন।
কুমার সিংয়ের শরীরে এখন যৌবন অবশিষ্ট নেই। তাঁর বয়স সত্তর বছর অতীত হয়ে গেছে। তাছাড়া শরীরটাও তাঁর ভালো নয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বড়ো একজন জমিদার। বছরে ব্রিটিশ সরকারকে কম করেও এক লক্ষ আটচল্লিশ হাজার টাকা খাজনা পরিশোধ করতেন। আর তিনি প্রজাদের কাছে যে টাকা খাজনা স্বরূপ আদায় করতেন, তার পরিমাণ ছিলো তিন লাখ টাকা। তিনি ছিলেন অশিক্ষিত। কর্মচারিরা তাকে নানাভাবে শোষণ করতো। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহসী, উদারচেতা ও দয়ালু জমিদার। কিন্তু অকর্মণ্য পরজীবী কর্মচারিদের স্বার্থপরতা বশতঃ তিনি এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা দেনাদার হয়ে পড়লেন। তিনি এবং তাঁর পাওনাদার কয়েকজন মিলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করলেন জমিদারী বন্ধক দিয়ে যেনো তাঁকে দেনা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। টেইলার এবং ড্যামপীয়ার এজন্য চেষ্টা করেও তাঁর জন্য কিছু করতে পারলেন না। কুমার সিং দেউলিয়া হয়ে পড়লেন। পিতৃপুরুষের জমিদারী হারিয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তাছাড়াও অন্যান্য রাজপুতদের মতো ইংরেজদের বাধা দেবার কথা তাঁর মনে কম সময়েই খেলে যেতো। যেদিন সেপাইরা আরাতে এলো সেদিনই জগদীশপুর থেকে কুমার সিং আরাতে এলেন। এখন কথা হতে পারে এ অল্প সময়ের মধ্যে কুমার সিং কিভাবে সেপাইদের সঙ্গে চুক্তি করে ফেললেন। কিন্তু তখনকার দিনে প্রত্যেক জমিদার কম বেশি আসন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতেন।