জুন মাসে দানাপুরে কোনো রকমের গোলমাল ঘটলো না। টেইলার মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছেন। তিনি সরকারকে বার বার অনুরোধ করেও সেপাইদের তখন নিরস্ত্র করার প্রস্তাবে রাজী করাতে পারেনি। তার গুপ্তচরেরা নানা সংবাদ পরিবেশন করতে লাগলো। কখনো খবর এলো সেরা জমিদারেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, কখনো খবর এলো ওহাবীরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। জুন মাসের ১২ তারিখে নজীব নামে এক ব্যক্তিকে শিখদের কাছে রাজদ্রোহ প্রচার করার সময় ধরা হলো। বিচার করে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো হলো। এখন টেইলার অনুভব করতে লাগলেন যে তাঁর আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তিনি মনে করলেন ওহাবী নেতৃবৃন্দকে এভাবে শক্তি বৃদ্ধি করতে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। সে সময়ে ছিলেন তিনজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ওহাবী নেতা। তাঁরা হলেন মৌলবি শাহ্ মুহম্মদ হোসেন, আহমদ উল্লাহ্ এবং ওয়ায়েজুল হক। তাঁদের এমনিতে গ্রেফতার করলে জনগণের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সে জন্য এক কৌশল অবলম্বন করলেন। শাসন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে এক অধিবেশনের আয়োজন করে উল্লেখিত তিনজন ওহাবী নেতাকেও ডেকে পাঠালেন। কিন্তু আলোচনার শেষে ওহাবী নেতৃবৃন্দ তিনজনকে তিনি আটকে রাখলেন। জানালেন যে রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে অন্তরীণাবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হবে। দামরাওনের মহারাজা এবং টিকারীর রাণীর প্রতিও অনুরূপভাবে সন্দেহ পোষণ করা হলো। বড়ো বড়ো জমিদারেরা এ সময়ে ব্রিটিশ শাসনকে সর্বান্তঃকরণে কামনা করেছিলেন। কিন্তু হালে মরচে ধরা বন্দুক পরিষ্কার করলেও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বলে সন্দেহ করা হতে লাগলো।
ওহাবী সম্প্রদায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। তাদের অন্যান্য দেশবাসীর ন্যায় ব্যক্তিগতভাবে হয়তো তাঁরা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছেন।
শান্তিতে বসে থাকার মানুষ টেইলার নন। ওহাবী নেতৃবৃন্দকে আটক করার পরে তিনি এক ঘোষণা জারী করলেন যে যার কাছে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে তা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই জমা দিতে হবে এবং রাত নটার পরে কাউকে ঘরের বাইরে আসার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করা হলো।
৩রা জুলাই বিকেলবেলা প্রচুর মুসলমান জনসাধারণের একটি শোভাযাত্রা নগর প্রদক্ষিণ করে। তারা নিশান বয়ে এবং ড্রাম বাজিয়ে রাস্তা পরিক্রমণ করতে থাকে। সরকারি আফিম এজেন্ট পঞ্চাশ জন নাজিব এবং আট জন শিখকে তাকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দান করলেন। কিন্তু লোকজন আসার আগেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হলো। তাঁর মাথা কেটে ফেলা হলো। তারপরে দাঙ্গাকারীরা হটে যেতে বাধ্য হলো, তাদের মধ্যে একজন নিহত এবং কয়েকজন ভয়ানকভাবে আহত হয়েছে; পীর আলী নামে একজন স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতা এবং একজন ওহাবীকে দাঙ্গাকারীদের নেতা হিসেবে গ্রেফতার করা হলো। তেতাল্লিশ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। সাধারণ আদালতে তাদের বিচার করে তাদের অপরাধ যাচাই করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হলো। টেইলার এবং পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট লুইস সাহেবও ছিলেন সে কমিশনের সদস্য। তাদের মামলায় কোনো সওয়াল-জবাব করা হয়নি। তেতাল্লিশ জনের মধ্যে উনিশ জনকেই ফাঁসি দেয়া হলো। পাঁচজনকে যাবজ্জীবন নির্বাসিত করা হলো, তিনজনকে বেত্রাঘাত এবং তিনজনকে মুক্তি দেয়া হলো।
টেইলার ব্যক্তিগতভাবে আসামীদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের মুক্তিপণ আদায়ের জন্য প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করতেন। একবার দেশীয় পুলিশ রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার হলে টেইলার নিজে তাঁকে বলেন, “তুমি আমাকে তিনজনের জীবন দাও, আমি তোমার জীবন ফিরিয়ে দেবো। পীর আলী ধনী ছিলেন না। সন্দেহ করা হয়েছিলো নিশ্চয়ই কোনো ধনী তাঁকে রাজদ্রোহের জন্য অর্থ সরবরাহ করছে। শেখ ঘাসিত নামে একজন লোককেও পীর আলীর সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হলো যে তিনি ছিলেন পাটনার প্রধান ব্যাংক মালিকের কর্মচারী। তাঁকে এ অভিযোগে আটক করা হলো যে তিনি হচ্ছেন একজন অচেনা ব্যক্তি এবং তিনি পীর আলীর ব্যবসায়ে অর্থ সাহায্য করেছেন। পাটনার কোনো ভারতীয় লয়েডের আচরণে সন্তুষ্ট না হলেও কোলকাতার ইউরোপীয় বণিকরা তাকে সমর্থন করতো। তাঁর কাজের যে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে সময় তিনি তা চিন্তা করে দেখেননি।
দানাপুর বিভাগের সামরিক অধ্যক্ষ প্রথমে বিদ্রোহ যে ঘটতে পারে, সে সম্বন্ধে চিন্তাও করেননি। কিন্তু সেপাইদের মধ্যে পূর্বে দৃষ্ট হয়নি এমনি এক ধরনের চাঞ্চল্য দর্শন করে বিদ্রোহের ব্যাপারে তিনি আঁচ করে নিলেন। কিন্তু ভারত সরকার তাঁর থেকে সেপাইদের নিরস্ত্র করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছেন।
নীল-চাষীরা অনেকে খবর সংগ্রহ করে ফেলেছে। তার উপর সরকার কি নির্দেশ দিয়েছেন, তাও তাদের কাছে গোপন নয়। লয়েডের কাছে গভর্ণর জেনারেল ১৫ তারিখে চিঠি লিখেছেন। ২০ তারিখে নীল-চাষীরা দানাপুরের সেপাইদের নিরস্ত্র করবার জন্য গভর্ণর জেনারেলকে অনুরোধ করলেন। তারা আরো ভালোভাবে জানতো তাদের টাকার থলি নিরাপদ রাখার জন্য এরকম একটি ভয়ঙ্কর উদ্যোগ গ্রহণ করতে তিনি অবশ্যই দ্বিধান্বিত হবেন। এভাবেই গোপন সামরিক নির্দেশ ফাঁস হয়ে গেলো। সেপাইদের বুদ্ধি যোগাবার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। তা অনেক সময় অফিসারদের পন্থার চাইতে দ্রুত এবং নিশ্চিত।