কাবুল যুদ্ধে পরাজয়ের পর হতভাগা সীতারাম শত্রু কর্তৃক বন্দী হলো এবং দাসরূপে তাকে বিক্রয় করা হলো। ইংরেজদের কাবুল পরিত্যাগ করার বহুদিন পরে সীতারাম এক ব্যবসায়ীকে পাঁচশ টাকা দিয়ে তার সাহায্যে পালিয়ে এসেছিলেন। তখনকার দিনে পাঁচশ টাকা কম টাকা নয়। ফিরোজপুরের কমিশনার এ টাকার অর্ধেক দিয়েছিলেন, বাকী অর্ধেক স্টেশনের এক পুরোনো পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে সে গ্রহণ করেছিলো। সেপাইদের কাছে ফিরে এসে সীতারাম যখন আত্মপরিচয় দান করলো তখন সেপাইদের সকলে একবাক্যে সীতারামকে অশুচি অপবিত্র এবং মুসলমান বলে ঘোষণা করলো। প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত সীতারামকে ব্রাহ্মণেরা অস্পৃশ্য বলে জানিয়ে দিলো এবং খ্রীস্টান ড্রামবাদক ছাড়া অন্য কোনো হিন্দুর সঙ্গে মেলামেশার অধিকার সীতারামের নেই। ইংরেজ অফিসারেরা সীতারামের এ হেনস্থার কথা জানতেন। তারা তার উপর যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তাহলে কি হবে, জাত ফিরে পেতে যতো টাকার প্রয়োজন, তখন সীতারামের হাতে ততো টাকা ছিলো না। সেপাইদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পরেও কিন্তু সীতারামের দুর্দশার শেষ হলো না। গ্রামে সীতারামের জন্য আরো অপমান অপেক্ষা করছিলো। সে যে আফগানিস্তানে দাস হিসেবে জীবনযাপন করেছে এ খবর বাতাসের বেগে সীতারামের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। তাকে পিতৃগৃহে থাকতে দেয়া হলো না। আপন ভাই তার শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। তার বাবা জাতে তুলবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন এবং তাকে সেপাইয়ের পেশা ছেড়ে দিতে জোর করতে থাকেন। নিজের স্ত্রী এবং পুত্রের কারণে সীতারাম বাবার প্রস্তাবে রাজী হতে পারেনি।
আফগান যুদ্ধের ফলে সেপাইদের শিক্ষা হলো, বিদেশে অভিযানে গমন করলে তাদের গৌরব তো বাড়ে না, বরঞ্চ স্বার্থ এবং সম্মানের যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করা তাদের সাধ্যের সম্পূর্ণ বাইরে। ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ করতে সেপাইদের বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। বিজয়েই সে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বিদেশে গোলামী এবং স্বদেশে অস্পৃশ্য হওয়ার যে ক্ষতি তা পূরণ করার জন্য ইংরেজ অফিসারদের সহানুভূতিই যথেষ্ট নয়। এতোকাল ব্রিটিশ সেনাপতিরা অজেয় বলে যে ধারণা পোষণ করে আসছিলো ভারত এবং নেপালের যুদ্ধে এশীয় সেনাপতি কর্তৃক পরিচালিত এশীয় বাহিনীর হাতে তাদের পর্যদস্ত অবস্থা সেনাপতিদের প্রতি পূর্বের সে অটল বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিলো।
১৮৩৯ সালে শাসকদের তাদের নিজেদের ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন, তারা অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেন। আওরঙ্গজেবকেও হিন্দুদের সামাজিক বিরোধে রায় দিতে দেখা গেছে। হিন্দু পেশবা একজন রোমান ক্যাথলিক যাজকের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন। এ সুপ্রাচীন প্রথা অনুসারে মন্দির এবং অন্যান্য ধর্ম স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উপর। এমনকি পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানীর ওপর অর্পিত হয়। স্বদেশে খ্রীস্টান মতামত কোম্পানীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো এবং কোম্পানী মূর্তিপূজার পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে গোঁড়া খ্রীস্টান মহলে অভিযোগ উঠতে থাকলো। বস্তুতঃ কোম্পানী মন্দির ইত্যাদি ধর্মস্থান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করছিলো। দর্শনার্থীদের প্রদত্ত অল্প টাকাই মন্দির সংস্কারের জন্য ব্যয় করতে হতো তাদের। কিন্তু ধর্মীয় ন্যায়-নীতির সঙ্গে পার্থিব লাভ-লোকসানের কোন সম্বন্ধ নেই। ভারতে হিন্দু-মুসলমান ধর্ম স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরিত্যাগ করার জন্য কোম্পানীর সরকারের ওপর ব্রিটেন হতে চাপ আসতে থাকে। এতোকাল ধরে ইংরেজরা যে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আসছিলো হঠাৎ সে মনোভাবের পরিবর্তন দেখা গেলো। ইউরোপ থেকে খ্রীস্টধর্ম প্রচারকের আগমন ঘটতে থাকে। হাট, ঘাট, বন্দর, জেল, হাসপাতাল, স্কুল সর্বত্রই খ্রীস্টধর্ম প্রচারের ভিড় লেগে গেলো।
বাজারে বাজারে খ্রীস্টধর্মের প্রচারকেরা বড়োই উৎপাত শুরু করে দিলো। তাদের নিজেদের ধর্মের গুণ-গান প্রচার তারা তো করলেই সে সঙ্গে এদেশের অধিবাসীদের সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদিকে জঘন্য ভাষায় বিদ্রূপ করা তাদের ধর্ম প্রচারের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো। মুর্তিপূজক হিন্দু এবং একেশ্বরবাদী মুসলমান উভয় ধর্মের প্রতি সমান তাদের আক্রোশ এবং যীশুখ্রীস্ট যে একমাত্র প্রেরিত পুরুষ তাই জোরগলায় প্রচার করতে লাগলো। বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ খ্রীস্টান প্রচারক এবং খ্রীস্টান শাসকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পেলো না। এর কারণ, অনেক সময় সঙ্গে পুলিশ নিয়ে খ্রীস্টান প্রচারকেরা ধর্ম প্রচার করতে যেতো।
স্যার সৈয়দ আহমদের ভাষায়, জনসাধারণ বিশ্বাস করতে লাগলো, সরকার ধর্ম প্রচারকদের মাইনে দিয়ে নিয়োগ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, জনসাধারণ যখন মন্দিরে, মসজিদে অথবা বাসগৃহে কোনো ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করতো সেখানে খ্রীস্টান প্রচারকেরা গিয়ে অত্যন্ত আপত্তিজনক ভাষায় তাদের ধর্মের নিন্দা করতো। সেপাইরাও জানতো যে সেনাবাহিনীর প্রধান পুরোহিতেরা সরকারের কাছ থেকে মাইনে পেয়ে থাকে। সেনাবাহিনীর প্রধান পুরোহিতকে বলা হতো পাদরী লাট।