বিদ্রোহীদের নেতা মৌলবি এবং বেগম নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফিরোজশাহ্ আবার যুদ্ধ করতে ছুটে গেলেন। কুমার সিং পুনরায় আজমগড়ে নিয়ে তার দুর্দমনীয় সাহস এবং অক্লান্ত শ্রমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। কিন্তু নওয়াব পরিবারের সকলে তেমন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী ছিলেন না, একরাতের মধ্যে ধনী বেগমেরা ভিখারিণীতে পরিণত হলেন। লখনৌর রাজপুরী সমস্ত রহস্য হারিয়ে ইটের স্তূপে পরিণত হলো।
মার্চ মাসের ২১ তারিখে রেভারেন্ড ম্যাককি একটি সরগরম সুললিত বক্তৃতা প্রচার করলেন। অন্যান মহান সাম্রাজ্যের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে না, কারণ ইংল্যান্ড হলো একটি খ্রীস্টান দেশ। সে নিশ্চয়তায় সামরিক এবং বেসামরিক অফিসারদের মাথাব্যথা কমলো না। লখনৌ অধিকারের পূর্বেই স্যার জেমস আউটরাম গভর্ণর জেনারেলের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু নগরী ব্রিটিশের হাতে না আসা পর্যন্ত সে নির্দেশ প্রচার করা হয়নি। সে আদেশ বলে অযোধ্যার ভূস্বামীদের সমস্ত কিছু ভেঙ্গে যাবে বলে তিনি এতোদিন প্রকাশ করতে সাহসী হননি। ছ’টি পরিবার ছাড়া অযোধ্যার সকল জমিদার এবং তালুকদারদের পূর্বপুরুষের জমিদারী এবং তালুকদারী কেড়ে নেয়া হয়েছে। গভর্ণর জেনারেল
অযোধ্যার জনসাধারণকে জানিয়ে দিলেন যে তাদের জীবন-মরণ সবকিছু এখন ব্রিটিশ সরকারের উপরই নির্ভর করছে। তিনি আরো জানিয়ে দিলেন, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা মস্ত অপরাধ করেছে। ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, এ ঘোষণার অব্যবহিত পরে যে সকল সর্দার, তালুকদার, ভূস্বামী চীফ কমিশনারের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তারা যদি ইংরেজ রক্তপাত না করে থাকেন, তাহলে তাদের ধন-প্রাণ অটুট থাকবে। লখনৌর পতন ঘটলেও অযোধ্যা অজেয় রয়ে গেলো। জেনারেল আউটরাম ভয় দেখিয়ে তালুকদারী বাজেয়াপ্ত করে জনসাধারণের আনুগত্য আদায় করতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনসাধারণ কিছুতেই আস্থা স্থাপন করতে পারলো না। ব্রিটিশ বিচারবোধ সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। জমিদারী এবং তালুকদারী রক্ষা করার জন্য পূর্বপুরুষেরা যেমন নওয়াবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি তারাও ইংরেজের বিরুদ্ধে জমির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেন। একবার বিদ্বেষের শিখা জেগে উঠতেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লো।
৬. বিহার: ওহাবী-সিপাহী যুগল সম্মিলন
লখনৌর দুঃখের কথা এসে পৌঁছোতেই পাটনার নিকটবর্তী স্থানে গোলমাল শুরু হলো। ১৮৫৭ সালে টেইলার নামে এক ভদ্রলোক পাটনা শাসন করতেন। তিনি কোনো কর্তব্যে ফাঁকি দিতেন না এবং কোন রকমের বাজে জিনিস সহ্য করতে পারতেন না। তিনি হচ্ছেন সে সব লোকদের একজন, যিনি জনমতকে উপেক্ষা করে নিজের খেয়াল-খুশীর উপরই অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি শাহবাদের বিচারক। ইউরোপীয় নীলচাষীরা তাঁর মতো একজন লৌহমানবের শাসনামলে অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ছিলেন। অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা শুরু হলে তাদের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না হলেও কম লাভ হবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। টেইলার ছিলেন বিহারের উপযুক্ত শাসক। তিনি সব সময় সন্দেহ করতেন, পাটনার লোকেরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কারণ পাটনা ছিলো ওহাবী আন্দোলনের শক্তিশালী কেন্দ্র। তার দৃষ্টিতে প্রত্যেক ওহাবীই ছিলেন একজন বিদ্রোহী। তাঁর অনুগত পাঁচ ছয় জন মানুষ যারা ব্রিটিশকে অপরিমেয় সাহায্য প্রয়োজনের সময় দান করেছে, তাদেরকে তিনি সম্প্রদায়ের ব্যতিক্রম মনে করতেন।
কলকাতা হতে বেনারস যাওয়ার যে রাজপথ এবং জলপথ, পাটনা অবস্থিত তার মধ্যস্থলে। তাকে সীমান্ত প্রদেশের চাবিকাঠি বললেও অত্যুক্তি হয় না। পার্শ্ববর্তী ক্যান্টনমেন্ট দানাপুরে তিনটি সেপাই রেজিমেন্ট (৭, ৮ এবং ৪০নং রেজিমেন্ট) এবং কোম্পানীর ভারতীয় গোলন্দাজ সৈন্য অপেক্ষা করছিলো। তাদের সঙ্গে ছিলো মহারাণীর ১০নং পদাতিক বাহিনী এবং এক কোম্পানীর ভারতীয় গোলন্দাজ সেনা। মীরাটের বিদ্রোহের পরে ভারতীয় সেপাইরা সামরিক বেসামরিক সেপাইদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সময় মেজর জেনারেল লয়েড ছিলেন দানাপুর ডিভিশনের অধিনায়ক। ৫৩ বছর ধরে তিনি সামরিক বিভাগে চাকুরি করেছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করে তিনি লর্ড ডালহৌসীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেরেছেন। দানাপুরের অধিকাংশ সেপাইয়ের বাড়ি হলো পার্শ্ববর্তী জেলা শাহবাদে। ৭ই জুন তারিখে তারা বেনারসের খবর শুনেছেন। খুব শীগ্গির একটা গোলমাল শুরু হবে সে বিষয়ে অনুমান করা হতে লাগলো। জেনারেল লয়েড সেপাইদের নিরস্ত্র করার কথা চিন্তা করতে লাগলেন, সে উদ্দেশ্যে মাদ্রাজ ১৫০জন থেকে সৈন্যও অবতরণ করানো হয়েছে, কিন্তু তারা অনুগত রয়ে গেলো।
মীরাটের বিদ্রোহের খবর শুনতে পেয়ে বিহারের জনজীবনে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। বেনারসের কাহিনী শুনে ইউরোপীয় মহলে আতঙ্ক জাগলো এবং অনেক ইউরোপীয় তাঁদের ঘাঁটি ত্যাগ করে গ্রামের দিকে নিরাপদে বাস করবার জন্য চলে গেলেন। দানাপুরে ৭ তারিখে বিদ্রোহ ঘটবে বলে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লো। জেনারেল টেইলার ইউরোপীয় অধিবাসীদের নিশ্চয়তার জন্য নিজের বাসভবনকে দুর্গে পরিণত করলেন। সমস্ত নর-নারীকে সেখানে আশ্রয় দেয়া হলো, পাহারা বসানো হলো।