জেনারেল ফ্র্যাঙ্ক পথ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন পালোয়ান সিং নামে এক শুখা অফিসার। তাঁরা বান্দা হাসান এবং মেহেদী হাসানের অধীন একদল অযোধ্যার সেপাইদের মোকাবেলা করলেন চান্দায়। সেদিন ছিলো ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। তারপরে মেহেদী হাসান বায়ুনের কাছে তাদের আবার বাধা দিতে চেষ্টা করে পরাজিত হলেন। পরবর্তী পর্যায়ে জেনারেল ফ্রান্স সুলতানপুরে যাত্রা করলেন। লখনৌর জেনারেল গফুর বেগের অধীন একদল শক্তিশালী সৈন্য তার মোকাবেলা করার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ঘোরতরো যুদ্ধের পর জয়লাভ করে সেনাদলের বিশ্রামের জন্য কয়েকদিন সেখানে অপেক্ষা করলেন। পরের দিন জলন্ধর থেকে আগত ৩নং শিখ বাহিনী তাঁর সঙ্গে যোগ দিলো। মার্চ মাসের ৪ তারিখে জেনারেল ফ্রাঙ্ক লখনৌ থেকে আট মাইল দূরে এসে উপনীত হলেন। ১১ই মার্চের আগে জং বাহাদুর লখনৌতে আসতে পারেননি।
এ সময়ে আউটরাম আলমবাগে প্রচণ্ড বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁর সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই অল্প। লখনৌর অতি নিকটে অবস্থিত ছিলো বলে সবসময়ে আলমবাগ বিদ্রোহীদের চোখের ওপর ছিলো। কানপুরের সঙ্গে অতিকষ্টে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় তাতেও বহুদিন সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। শীগগির যদি অযোধ্যা আক্রমণ না করা হয়, তাহলে কানপুরের নিকটবর্তী কোনো ঘাঁটিতে গিয়ে উঠতে তিনি বাধ্য হবেন। আলমবাগের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিলো না। কিন্তু যদি অযোধ্যা আক্রমণ করা হয়, তা হলে তিনি সর্বশক্তি ব্যয় করে আলমবাগ দুর্গ রক্ষা করবেন। ৬ বার আক্রমণ করে স্থানটিকে তিনি বিদ্রোহীদের হাত থেকে মুক্ত করে নিলেন। রাণী নিজে কয়েকবার এসে তার সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করেছেন। সেপাইরা প্রথম দিকে ভালোভাবে যুদ্ধ করলেও কোনো উপযুক্ত নেতার অভাবে শেষ পর্যন্ত তাদের উৎসাহ অটুট রইলো না। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল অযোধ্যা আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত আউটরাম বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনমাস ধরে বিদ্রোহীদের হাত থেকে দুর্গ রক্ষা করেছেন। প্রধান সেনাপতি ব্রিগেডিয়ার হোপ গ্র্যান্টকে ফতেহপুর চৌরাশিতে পাঠালেন। কারণ গুজব রটেছে যে নানা সেখানে আত্মগোপন করে আছেন। হোপ গ্র্যান্ট ১৭ই ফেব্রুয়ারি সেখানে পৌঁছে বিদ্রোহী সর্দার ঝামা সিংয়ের ভাঙ্গা কেল্লা জ্বালিয়ে দিলেন, কিন্তু নানা সেখানে ছিলেন না। হোপ গ্র্যান্টকে নির্দেশ দেয়া হলো, তিনি যেনো ১লা মার্চ তারিখে বানতেরাতে তাঁর প্রধান সেনাপতির সঙ্গে মিলিত হন। তার আগের দিন স্যার কলিন ক্যাম্পবেল কানপুর ত্যাগ করেছেন, অশ্বারোহণে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে আলমবাগ এবং আলমবাগ থেকে নতুন সদর দফতর বানতেরাতে এসে পৌঁছালেন। ২রা মার্চ তারিখে লখনৌ আক্রমণ শুরু হলো।
এ সময়ের মধ্যে লখনৌর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। শহরের প্রত্যেক লাইনে মৃত্তিকা প্রাচীর তোলা হয়েছে, কিন্তু গোমতীর উত্তর তীরের প্রতি তারা কোনো দৃষ্টি দেয়নি। স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে ছিলো নব্বই হাজার সৈন্য। জং বাহাদুর এবং জেনারেল ফ্র্যাঙ্কের যোগ দেয়ার ফলে সৈন্যসংখ্যা বেড়ে গেলো আরো তিরিশ হাজার। আউটরাম নদীর উত্তর পাড়ের দিকে ধাওয়া করলেন। সে দিকে শত্রুসৈন্যের সঙ্গে মোকাবেলা করার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করা হয়েছিলো। তাঁর কর্মসূচি শেষ করে লৌহের সেতুর পাশে এসে গেলেন, কিন্তু তাঁকে সেতু অতিক্রম করতে দেয়া হলো না। গোমতীর দক্ষিণ পাড়ে প্রধান বাহিনী দিলখুশা দখল করে নিলেন। একের পর এক সুরক্ষিত অট্টালিকাসমূহের পতন ঘটতে থাকে। বিদ্রোহীরা তাদের অবস্থা খারাপ দেখে নগর থেকে পলায়ন করতে লাগলো। দুর্জয় সাহসের সঙ্গে তারা সগ্রাম করেছে, বেগম কুঠি যখন আক্রমণ করা হয়েছিলো তখন ৮৬০জন প্রতিরক্ষী মৃত্যুবরণ করেছিলো। চরমতম বিপদের সময়ও তারা পলায়ন করেনি। রাজমাতা নিজেও সাহস হারাননি, সব সময় সেপাইদের মধ্যে সাহস এবং উদ্দীপনার সঞ্চার করেছেন। কিন্তু কিছুতে কিছু হলো না। ১৮ তারিখে শহরের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ব্রিটিশের হাতে চলে গেলো। বেগম কর্তৃক অনুপ্রাণিত একদল দুঃসাহসী বিদ্রোহী সেপাই ১৯শে মার্চ পর্যন্ত মুসাবাগ রক্ষা করেছিলেন। মৌলবি সাহেব সকলের চেয়ে অধিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন, ২২ তারিখের পূর্বে তাঁকে পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। এভাবে লখনৌ বিজিত হলো, কিন্তু লখনৌ এখনো অজেয় রয়ে গেছে। বন্দী মহিলারা তখনো আশা করতেন, সেপাইরা জয়লাভ করবে।
অধিকার করার পরে অন্যান্য শহরের ভাগ্যে যা ঘটেছে লখনৌও তা এড়াতে পারেনি। বেগম কুঠি যেভাবে লুটপাট করা হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সেপাইরা মালখানা ভেঙ্গে জিনিসপত্র এনে প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে দিলো। জড়োয় জড়ানো পোশাক, অলংকার, রৌপ্য নির্মিত বাদ্যযন্ত্র, বই, ছবি, অস্ত্রশস্ত্র আরো নানাবিধ জিনিসপত্র উচ্ছল সৈন্যেরা একাকার করে ফেললো। আগুন জ্বালিয়ে সোনা-রূপার জড়োয়া জড়ানো শাল, কাপড়-চোপড় ইত্যদি নিক্ষেপ করে রই আভরণ আলাদা করে রাখলো। রাসেল বলেছেন, লখনৌর প্রাসাদে ইংরেজ সৈন্য যেভাবে লুঠপাট করেছে, পৃথিবীতে কোথাও তেমন ঘটেছে কিনা তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না। এমনকি তাদের হাত থেকে গরু বাছুর, কবুতর পর্যন্ত রেহাই পায়নি।