তারপরে বিঠোরের দিকে বিজেতাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। ব্রিগেডিয়ার হোপ গ্র্যান্টকে সেখানে পাঠানো হলো। বলা হয়ে থাকে যুদ্ধের আগের দিন নানা প্রাসাদে নিদ্রা গিয়েছিলেন। তাঁর প্রাসাদ নয় শুধু, দেবদেবীর মন্দির কিছুই ব্রিটিশ প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি। নানা সাহেব বিঠোর থেকে অযোধ্যা চলে যাবার সময় তাঁর রত্ন আভরণ নিয়ে যেতে পারেননি। ব্রিটিশ সৈন্য তার প্রাসাদ লুঠপাট করলো। ধন-সম্পদ যা নিয়ে যেতে পারেননি, কুয়োর পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। পাম্পের সাহায্যে জল অপসারণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বালতি দিয়ে জল সরিয়ে ধন-সম্পদ উদ্ধার করে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।
দিল্লী দখল করার কাজ শেষ, কানপুর মুক্ত এবং লখনৌকে মুক্ত করা হয়েছে, এখন শুধু বাকী ফতেহগড়ের পুনরুদ্ধার সাধন। ফারাক্কাবাদ থেকে কয়েক মাইল দূরে ফতেহগড় এককালের পাঠান নওয়াবদের রাজধানী, কানপুর থেকে আগ্রা পর্যন্ত যে রাস্তা তার মধ্যস্থলে অবস্থিত বলে ফতেহগড়ে সামরিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। কর্ণেল স্মিথ এখানে একটি বন্দুক নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন সেপাইদের বিদ্রোহ করার প্রাক্কালে। বিদ্রোহের সময়ে কর্ণেল স্মিথই ছিলেন দুর্গের অধিনায়ক। তার আগে কর্ণেল ভাবলেন, নারী, পুরুষ এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের কানপুরে পাঠিয়ে দেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে কতিপয় দেশীয় অফিসার তাকে জানালেন যে তাঁরা আর তাঁর আদেশ মেনে চলবেন না। ইউরোপীয়রা দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে দুর্গ রক্ষা করতে অপারগ হওয়ায় তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা তিনখানি নৌকাযোগে পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। এ সকল নৌকায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হলো, আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই বিঠোরে গিয়ে ধরা পড়লেন। ১৮ই জুন তারিখে সেপাইরা ফারাক্কাবাধের নামমাত্র নওয়াবের অধীনে দুর্গের শাসনভার গ্রহণ করলেন।
স্যার কলিন ক্যাম্পবেল ফতেহগড়ের বিদ্রোহীদের সকল দিক থেকে বেষ্টন করতে ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। স্যার ক্যাম্পবেলের সুসংহত আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহীরা দোয়াব অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো। তারা অযোধ্যা এবং রোহিলাখণ্ডের দিকে ধাবিত হলো। অতি অল্পদিনের মধ্যে ফতেহগড় দুর্গ বিজিত হলো।
বহুদিন পর গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড বিদ্রোহীদের হাত থেকে মুক্ত হলো। বাঙলা থেকে পাঞ্জাব, কলকাতা থেকে লাহোর পর্যন্ত যোগাযোগ আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু অযোধ্যা এবং রোহিলাখণ্ড এখনো বিদ্রোহীদের হাতে। ফতেহগড়ের পতনের ফলে রোহিলাখণ্ডের পথ পরিষ্কার হয়েছে। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। তিনি অযোধ্যায় ১৮৫৮ সালের শরঙ্কাল পর্যন্ত কোনো হস্তক্ষেপ না করে শাহরানপুর এবং বেরিলীতে তার সৈন্য সমাবেশ করলেন, কারণ তিনি খবর পেয়েছেন, ঐ দু’অঞ্চলে বিদ্রোহীরা জমায়েত হয়েছে। অন্যান্য স্থানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করা সম্ভব হলে অযোধ্যার সেপাইদেরকে পরাজিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলে মনে করলেন। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল একাই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। তার যুক্তি হলো ভারতে সকলের দৃষ্টি অযোধ্যর দিকে নিবদ্ধ। সুতরাং অয্যোধ্যার সেপাইরা পরাজিত হলে সমগ্র ভারতের সেপাইদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। রাজনৈতিক কারণে রোহিলাখণ্ডের বদলে অযোধ্যা আক্রমণই প্রাধান্য দেয়া হলো।
উত্তর দিক থেকে অযোধ্যা আক্রমণ করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। নেপালের রাজা জং বাহাদুর প্রয়োজনের সময় ইংরেজদেরকে সাহায্য করে বন্ধুত্বের ভিত্তি পাকা করে গড়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সকল স্থানে ব্রিটিশের মর্যাদা হ্রাস পেতে থাকে। এ দুঃসময়ে জং বাহাদুর ব্রিটিশ সরকারকে তাঁর সাহায্য দানের প্রস্তাব করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রস্তাব গৃহিত হলো, কারণ লর্ড ক্যানিং তার বন্ধুত্বপূর্ণ আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মনে করলেন। জুলাই মাসে ৩ হাজার লোকের একটি গুখা সেনাবাহিনী গোরক্ষপুর জেলায় প্রবেশ করলো। নাজিম অথবা গভর্ণরের অধীনে এখানে একটা বিদ্রোহী সরকার গঠিত হয়েছিলো। আগেকার ব্যবস্থা অনুসারে মুহম্মদ ছিলেন নাজিম, কিন্তু রাজ্য কেড়ে নেয়ার পর তিনি সে পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কর্ণেল লেনোস্ক এবং অন্যান্য আশ্রয় প্রার্থীদেরকে তিনি নিজে ঝুঁকি গ্রহণ করেই আশ্রয় দান করেছেন। যতদূর সম্ভব তিনি যে ব্রিটিশ মিত্র এটা প্রমাণ করার জন্য তিনি এক ফোঁটা রক্তপাত করেননি। প্রথমে গুখা সৈন্যদের তার বিরুদ্ধেই নিয়োগ করা হলো। তারপরে গোরক্ষপুর থেকে জানুপুর এবং আজমগড়ে শুখা সৈন্য চলে গেলো। অল্প সংখ্যক সৈন্য পাঠিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে নেপালরাজ নিজে এসে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব করলেন। ২১শে ডিসেম্বর তারিখে রাজা জং বাহাদুর দশ হাজার গুখা সৈন্যসহ এসে হাজির হলেন সীমান্ত প্রদেশে। সেখানে তিনি গভর্ণর জেনারেলের নেপালী সৈন্যদের এজেন্ট ম্যাক গ্রেগরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।
পরবর্তী অভিযানের লক্ষ্য অযোধ্যা যখন স্থির হলো প্রধান সেনাপতি ফতেহগড় থেকে কানপুরে চলে এলেন। শীতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান শুরু হলো না। পূর্বদিক থেকে জেনারেল ফ্রাঙ্কের অযোধ্যায় প্রবেশ করার কথা এবং রাজনৈতিক কারণে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের জং বাহাদুরের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে আক্রমণ করার কথা স্থির করেছিলেন, কিন্তু ২৭ তারিখের পূর্বে জং বাহাদুর এবং জেনারেল ফ্রাঙ্ক আসতে পারছেন না। লর্ড ক্যানিং জং বাহাদুরের জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচনা করলেন।