অনেকদিন থেকে গোয়ালিয়রের বিদ্রোহীরা অকেজো হয়ে পড়েছে। জুনের প্রথম দিকে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিলো। এতোকাল কেননা তারা কিছু করেনি তা এখন আর রহস্য নয়। ইন্দোরের বিদ্রোহীরা মাদ্রাজের বিরুদ্ধে মার্চ করলে তাদের গোয়ালিয়রের বন্ধুরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। হ্যাভলকের অধীনে যখন মাত্র অল্প সংখ্যক সৈন্য তখনও তারা কানপুর আক্রমণ করেনি। তারা যদি তখন তাঁকে আক্রমণ করার জন্য মনস্থির করে উঠতে পারতো, তাহলে ব্রিটিশ সৈন্য কানপুর ত্যাগ করতে বাধ্য হতো এবং সেপাইদের সংগ্রাম জনসাধারণের শ্রদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতো। তারা এমন অলস রয়ে গেলো যে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তাদের হাত থেকে খসে পড়লো এবং হ্যাভলক ও আউটরাম লখনৌতে যাত্রা করলেন। যদি কোনো দূরদর্শী নেতা থাকতো তাহলে এ সঙ্কটকালে ব্রিটিশ সৈন্যকে আক্রমণ করে ছারখার করে ফেলতে পারতো। গোয়ালিয়রের সেপাইদের মধ্যে দেখবার চোখ এবং পরিকল্পনা করার মগজ বিশিষ্ট একজন লোকও ছিলো না। তারা সিন্ধিয়ার রূপার প্রলোভনের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। মহারাজের ইংরেজ বন্ধুরা তাঁকে এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে পুরোনো ঘাঁটিসমূহে বিভিন্ন উপায়ে বিদ্রোহীদের নিষ্ক্রিয় করে রাখার জন্য প্রচুর অর্থ দান করেছেন। ব্রিটিশের জন্য এটা কম সুযোগের বিষয় নয়। এতগুলো সৈন্যের সহযোগিতা থেকে সেপাইরা বঞ্চিত হলো। তারা আগ্রার দুর্গ অবরোধ করতে পারতো, তারা দিল্লীর সেপাইদের সঙ্গে যোগ দিতে পারতো, এমন কি দেশের অভ্যন্তরে তারা গ্যারিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতো, কিন্তু তারা কিছুই করলো না। অক্টোবর মাসে তারা শৈথিল্য ঝেড়ে ফেলে কল্পি অধিমুখে যাত্রা করলো। তাতিয়া তাদের দোদুল্যমানতার সুযোগ গ্রহণ করে অধিনায়ক পদে বরিত হলেন। একই সময়ে কুমার সিং বান্দা থেকে কম্লিতে আসছিলেন। এমনও হয়ে থাকবে তাতিয়া টোপীর এজেন্টরা গোয়ালিয়রের মানুষদের শেষ পর্যন্ত রাজী করাতে পেরেছিলো। কিন্তু তখনও তাদের গতিবিধি ধীর এবং সন্দেহজনক। তারা ছিলো সংখ্যায় ৫ হাজার শক্তিশালী সেপাই এবং গোলন্দাজ বিভাগে তাদের খুব ভালো ট্রেনিং ছিলো।
সিপাহী বিদ্রোহ যে সকল পারঙ্গম নেতার সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে রামচন্দ্র পান্ডুরঙ্গ ওরফে তাঁতিয়া টোপী তাদের অন্যতম। তার বাবা বাজীরাওয়ের একজন সামান্য প্রজা ছিলেন। তাঁতিয়া টোপী ছিলেন নানার ব্যক্তিগত অনুগৃহীতদের মধ্যে একজন। আনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতার বন্ধনে তিনি সব সময় নানা সাহেবের সঙ্গে আবদ্ধ ছিলেন। তাঁর কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছিলো না। কিন্তু বেড়া দেয়ার জ্ঞান এবং অব্যর্থ লক্ষ্য তাঁকে অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিলো। তাঁর কওমের গ্যারিলা যুদ্ধ সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিলো। ব্রিটিশ সৈন্য যখন মনে করেছে তাকে ঘেরাও করেছে, তখনও তিনি তাদের হতবুদ্ধি করে ছেড়েছিলেন। ১৩ তারিখের পূর্বে যদি তিনি কানপুরে উপস্থিত হতেন, তাহলে কানপুরের ব্রিটিশ সৈন্যাধ্যক্ষ উইন্ডহামকে পরাজিত করার সমস্ত সুযোগ লাভ করতেন। কিন্তু ১৭ তারিখে যে দিন স্যার ক্যাম্পবেল রেসিডেন্সীতে প্রবেশ করলেন তখনও তাঁতিয়া টোপীর অগ্রবর্তী শিবির গন্তব্যস্থল থেকে পনেরো মাইল দূরে রয়েছে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে উইন্ডহ্যাম অপূর্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করছিলেন। সাহসে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর অধিনায়ক অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে তাঁকে ছাউনির ভিতরে যুদ্ধ করতে বারণ করছেন। ১৭ তারিখে উইন্ডহ্যাম শহরের বাইরে চলে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের একটি সাহসী এবং বলিষ্ঠ আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি শহর এবং শহরতলীকে হত্যা এবং লুঠতরাজ থেকে রক্ষা করতে পারবেন। ইতিমধ্যে লখনৌর সঙ্গে তাঁর সকল রকম যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। ২৪ তারিখে তিনি কল্পির রাজপথ এবং খালের সংযোগস্থলে ছাউনি ফেললেন এবং শত্রুদেরকে প্রথমবারের মতো আঘাত করতে তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। ২৬ তারিখে তিনি তাঁতিয়া টোপীর এক ডিভিশন সৈন্যকে পশ্চাদ্ধাবনে বাধ্য করলেন । তারা পেছনে দুটো কামান ফেলে যেতে বাধ্য হলো। পরের দিন তাঁর শিবির ঘেরাও করা হলো। তার পরের দিন তার অবস্থা আরো সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলো, তিনি শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এবং ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
২৮ তারিখে কামানের গর্জনে সচকিত হয়ে স্যার কলিন তাড়াতাড়ি কানপুরে ধাওয়া করলেন। তাড়াতাড়ি সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে একখানা পত্র প্রেরণ করা হলো। পর পর আরো দু’বার সংবাদ পাঠানো হলো যে উইন্ডহ্যাম ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধান সেনাপতি তার সেনাবাহিনী এবং কনভয়কে পেছনে পেছেনে ঠেলে দিয়ে অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ যাত্রা করলেন। তার সৌভাগ্য সেতুর নৌকাগুলো তখনো অক্ষত আছে। যখন তিনি কানপুরে গিয়ে পৌঁছেছেন, তখন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর বড়ো দুরবস্থা।
ক্যাম্পবেল গিয়েই আক্রমণ করতে পারলেন না। তাঁর সামরিক কনভয় নিরাপদে এলাহাবাদ রাজপথে না আসা পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করতে পারলেন না। নারী শিশু এবং রোগীদের সরানোই তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু তাঁতিয়া টোপী তাঁকে বিব্রত না করে ছাড়লেন না। ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে ব্রিটিশ শিবির লক্ষ্য করে প্রবল গোলাবৃষ্টি করা হলো। তিনি সেতুর নৌকাগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সেতুটা এখন সুরক্ষিত। ডিসেম্বর মাসের ৬ তরিখে স্যার ক্যাম্পবেল তাঁতিয়া টোপীর সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করলেন। তাঁতিয়া টোপীর সেনাবাহিনীর কেন্দ্রস্থলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিলো, সে কারণে ডান দিকে আক্রমণ করে নানার সৈন্যদের থেকে গোয়ালিয়রের সেপাইদের আলাদা করে ফেলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। নানার সেনাবাহিনী শত্রুদের চাইতে অনেক বড় ছিলো, কিন্তু তারা বিভিন্ন দিকে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কেউ রান্না করছিলো, কেউ পান খাচ্ছিলো, কেউ কেউ চা-পাতি তৈরি করেছিলো। এমন সময় আকস্মিক আগমনে আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারলো পলায়ন করলো। কিন্তু ম্যাক্রফিল্ড তাঁর সেনাবাহিনীকে পুরোনো ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়াটা পছন্দ করলেন না। বিঠোরের রাজপথ বেয়ে আবার বিদ্রোহীরা ফিরে এলো। তাতিয়ার অবস্থানের মধ্যভাগ এখনো শহর রক্ষা করে চলছে, কিন্তু তাঁর ডানভাগ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ৮ তারিখে হোপ গ্র্যান্ট বিঠোর যাত্রা করলেন, কিন্তু জানতে পারলেন, সেপাইরা সেরাই ঘাটে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে সেপাইদের ওপর আক্রমণ চালালে তারা পুনরায় পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এভাবে তাতিয়া টোপীর কানপুর আক্রমণ এবং মূল আক্রমণস্থল থেকে স্যার ক্যাম্পবেলের যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়া হলো। যদিও তাঁর সৈন্য বাহিনী ভেঙ্গে গেছে, কামানগুলো হারিয়ে ফেলেছেন, তথাপি তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীর আতঙ্কের কারণ হয়ে রইলেন।