ক্যাম্পবেল ৩রা নভেম্বর তারিখে কানপুর ত্যাগ করলেন। দিল্লীর পতন হওয়ায় দু’টি সেনাদলকে ব্রিগেডিয়ার উইলসন পাঠাতে পারলেন। একটি দল বুন্দেলশর এবং আলীগড় হয়ে আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলেন গ্রীথিডের নেতৃত্বে। আগ্রাতে গ্রীথিড ইন্দোরের যে সকল বিদ্রোহী হঠাৎ আক্রমণ করে শহর দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলো তাদের দমন করলেন এবং সেনাবাহিনী কানপুর অভিমুখে যেতে লাগলো। অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে তারা কানপুরে এসে পৌঁছলো তখন কর্ণেল হোপ গ্রান্ট সেনাবাহিনীর অধিনায়ক পদে বৃত হয়েছেন। তিনি আলমবাগ অভিমুখে ধাওয়া করলেন এবং বানতেরাতে বিদ্রোহী সেপাইদের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। তিনি শিশু নারী এবং রোগীদের আলমবাগ থেকে কানপুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন এবং নিজে বানতেরাতে অবস্থান করতে লাগলেন। প্রধান সেনাপতির নির্দেশমতো ৩ মাইল ঝটিকা সফর শেষে প্রধান সেনাপতিও তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিলেন।
ক্যাম্পবেল চিন্তা করলেন, একজন ইউরোপীয় পথ প্রদর্শক পেলে তার অনেক সুবিধা হবে। টমাস হেনরী ক্যাভানগ যিনি অবরুদ্ধ ছিলেন, স্বেচ্ছায় একজন ভারতীয় গুপ্তচরসহ প্রধান সেনাপতির শিবিরে এসে হাজির। তিনি লোকটাকে আউটরামের সমস্ত চিঠিপত্র এবং পরিকল্পনা বয়ে নেয়ার কথা বললেন। কিন্তু লোকটি কোনো ইউরোপীয়কে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে সঙ্কোচবোধ করছিলো। তার ধারণা তিনি একাই শহরে এবং সামরিক ঘাঁটিসমূহে সকল রকমের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ক্যাভানগকে সঙ্গে নিলে তার নীল চোখ দেখেই সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। সে যাহোক ছদ্মবেশে ভারতীয় গুপ্তচরের সঙ্গে ক্যাভানগ বেরিয়ে পড়লেন।
স্যার কলিন রেসিডেন্সীর দিকে অগ্রসর হবার সময় বিপদসঙ্কুল লখনৌর রাজপথ বর্জন করতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁর সঙ্গে আউটরাম এবং হ্যাভলকের সেনাদলের চাইতে অধিক শক্তিশালী একদল সৈনিক রয়েছে, তবু তিনি কোনো রকমের সামরিক ঝুঁকি গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার গতিবিধি ছিলো ধীর এবং সতর্ক। তিনি ১৩ই নভেম্বর আলমবাগ থেকে যাত্রা করলেন এবং দিলখুশা দখল করলেন। তাঁর আসল লক্ষ্য ছিলো মতিমহল আক্রমণ করা। পূর্বকৃত পরিকল্পনা অনুসারে আউটরামের তার সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা। শত্রুদের মধ্যে ভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য তিনি বেগম কুঠিতে গোলা বর্ষণ করার নির্দেশ দান করলেন। ১৬ তারিখে যেখানে গোমতীর সঙ্গে খালটি যুক্ত হয়েছে, সে স্থান অতিক্রম করে সিকান্দরবাগ আক্রমণ করে বসলেন। এদিক দিয়ে যে কোনো আক্রমণ হতে পারে, বিদ্রোহী নেতারা তা কখনো আশা করতেও পারেননি। যে সকল সেপাই সিকান্দরবাগ পাহারা দিচ্ছিলো, তাদের সঙ্গে কোনো কামান ছিলো না। দুর্গ প্রাচীর ছিলো শক্ত এবং সেপাইরা প্রাণপণে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেলো। কামানের সামনে বন্দুক টিকতে পারলো না। ফাঁদে আটকা পড়ে একজন সেপাইও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলো না। বাগানে। দু’হাজার সেপাইয়ের লাশ পড়ে রইলো।
তারপরে কদম রসুল এবং শাহ্ নজফ আক্রমণ করা হলো। শাহ্ নজফ হলো অযোধ্যার ভূতপূর্ব শাসকের সমাধি। পুরো দেয়াল সহজে ভাঙ্গতে পারলো না। হঠাৎ ৩৩নং বাহিনীর কিছু সৈনিক আবিষ্কার করলো যে একটি প্রবেশ পথে ঘোট ফুটো দেখা যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে মোতিমহলের দিকে গিয়েছে যে অট্টালিকা তা উড়িয়ে দিলেন। ১৭ তারিখে অবরুদ্ধ নরনারী মুক্তিবাহিনীর দেখা পেলেন। চারদিনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৪৯৬ জন অফিসার হতাহত হয়েছেন। প্রধান সেনাপতি স্বয়ং আহত হয়েছেন। অবশেষে লখনৌকে মুক্ত করা হলো, অবরুদ্ধ নর-নারীরা মুক্তিলাভ করলো। বহুদিন অভুক্ত থেকে তারা পেট পুরে খেতে পেলো। অনেকদিন পর পত্রিকা পড়তে পারলো। কিন্তু আনন্দ কোথায়? কতো স্ত্রী বিধবা হয়েছে। কতো স্বামী পরিবার-পরিজন হারিয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত নরনারীর মনে প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা উথলে। উঠলো। বিজয়ের মুহূর্ত তাদের জন্য দুঃখের মুহূর্তে রূপান্তরিত হলো। তখন হ্যাভলক মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ২৪শে নভেম্বর তিনি মারা গেলেন। নগরের অদূরের আলমবাগে তাঁকে সমাহিত করা হলো। ক্যাম্পবেল রেসিডেন্সীতে বেশিদিন থাকা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি নারী, শিশু এবং রোগীদেরকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবার কাজে হাত দিলেন। তাঁর গতিবিধি সম্বন্ধে শত্রুদের অজ্ঞ রাখার জন্য তিনি কায়সারবাগে একটি কামান স্থাপন করলেন। বাতি জ্বালিয়ে যখন রেসিডেন্সীর অধিবাসীরা চলে গেলো সেপাইদের কোনো সন্দেহ রইলো না যে তারা চলে গেছে। ইউরোপীয়রা চলে যাওয়ার অনেক পরে তারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আউটরাম নিজেই সবশেষে দুর্গ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইঙ্গলিস জেদ করতে লাগলেন যে তিনি নিজেই তাঁর দুর্গের দ্বার বন্ধ করবেন। কিন্তু ক্যাপটেন ওয়াটারম্যানই সবশেষে দুর্গত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনী চলে যাবার সময় তিনি নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ জেগে উঠে তিনি অপরিসীম নিস্তব্ধতার ভারে ডুবে গেলেন। তারপরে তাড়াতাড়ি দৌড়ে একটা ঘাঁটিতে গেলেন। সেখানে কোন জনপ্রাণী নেই। সকলে চলে গেছে, পরক্ষণে তিনি দৌড়াতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পর সেনাবাহিনীর শামিল হলেন।