হ্রস্বতম পথ সব সময়ে নিরাপদ নয়। ছারবাগ ব্রিজ এবং খাল অতিক্রম করে যাওয়াই হলো তাদের পক্ষে সবচেয়ে সোজা পথ। কিন্তু পথে যুদ্ধ হলে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে নিরাপদ রাস্তা হলো দিলখুসার ওপর দিয়ে মার্চ করে গোমতী নদী অতিক্রম করা। তারপরে বামে ঘুরে শহরের অদূরস্থ লোহার সেতু দখল করে পুনরায় শহরের পাশে নদী অতিক্রম করে বাদশাহবাগ অতিক্রম করে অবরুদ্ধদের মুক্তি দান করা। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের দরুন ভারী কামানপাতি বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো এবং সেজন্য এ পথও বাদ দিতে হলো।
অনেক ক্ষতি সহ্য করার পরে প্রথম মুক্তিবাহিনী এসে পৌঁছালো। কিন্তু তাদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিলো। হ্যাভলক তাঁর ইউরোপীয় সৈন্যদের প্রত্যেক দেশীয় সেপাইদের শত্রু ভাবতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদের প্রথম জিঘাংসার শিকার হলো সে সকল অনুগত দেশীয় সেপাই, যারা এতোকাল ধরে অবরুদ্ধদের সঙ্গে যথেষ্ট দুঃখ-কষ্ট এবং লাঞ্ছনা ভোগ করেছে। কিন্তু মিসেস বাটুসের সঙ্গে তার সৈন্যরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তার কোনো তুলনাই চায় না।
ভদ্রমহিলার স্বামী ছিলেন গোণ্ডা অঞ্চলের সামরিক চিকিৎসক। স্যার হেনরী লরেন্স যখন বাইরের ঘাঁটির মহিলা এবং শিশুদেরকে লখনৌতে প্রেরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি প্রথমে সিকরোরাতে এসেছিলেন, সেখান থেকে একদল সেপাই তাঁকে রামনগর পৌঁছে দিয়ে আসে। সেখান থেকে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে তিনি লখনৌ অভিমুখে যাত্রা করেন। ডঃ বাট্রস যিনি পেছনে ছিলেন, বলরামপুরের রাজপ্রাসাদে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছিলেন। তিনি বন্ধুভাবে সেপাইদের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন অশুপূর্ণ নয়নে। ডঃ বাট্রস হ্যাভলকের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। পূর্বের দিন উদ্ধারকারী সেনাদল এসে পৌঁছেছে। মিসেস বাট্রুস জানেন যে তাঁর স্বামী সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছেন। কতিপয় অফিসার জানালেন যে, ডঃ বাট্রস জানেন যে, তাঁর স্বামী পরের দিন আসবেন। কিন্তু তিনি পরের দিন এলেন না। অবশেষে তিনি জানতে পেলেন, রেসিডেন্সির ফটকের বাইরে তার স্বামী নিহত হয়েছেন।
রেসিডেন্সীর রসদ ফুরিয়ে এলো। কমিসারিয়েট আর আটা সরবরাহ করতে পারছেন না, তার বদলে গম দেয়া হলো। সকলকেই সাধ্যমতো গম পিষতে হতো। ডাল খাওয়া এখন পরিপূর্ণরূপে বন্ধ করা হয়েছে। নুনের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। দৈনিক ৬ আউন্সের বেশি মদ কারো জন্য বরাদ্দ করা হয় না। ৩রা অক্টোবর তারিখে কোথাও চিনি পাওয়া গেলো না। এক সের চিনির জন্য পঁচিশ টাকা দিতেও তাঁরা রাজী ছিলেন। ২৪ তারিখে রেশনের পরিমাণ আরো কমিয়ে দেয়া হলো, যাতে করে জমা রসদে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। স্যার জেমস আউটরাম একটা লোককে এক হাজার টাকাসহ চিনি যোগাড় করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একদানা চিনিও যোগাড় করা সম্ভবপর হয়নি।
এই সময়ের মধ্যে মানসিং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বেশিদূর এগুতে পারেননি। তিনি নির্দিষ্টভাবে কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি, তবে কথা দিয়েছেন তিনি ইংরেজদের সমর্থন করবেন। তিনি দু’পক্ষের যুদ্ধের গতি দেখছিলেন। বিশেষ দিকে মোড় নেয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করছিলেন। জুলাই মাসে তিনি তাঁর অন্যান্য তালুকদার ভাইদেরকে ইংরেজ পক্ষ সমর্থন করার জন্য প্রচারপত্র পাঠালেন। কিন্তু তা তাদের সিদ্ধান্তকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। লখনৌ ত্যাগ করার পূর্বে সেপাইদের আটককৃত সীতাপুরের মিস ম্যাডেলিন জ্যাকসন এবং মিসেস ওরকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সমবায়ে একটা সরকার গঠন করে লখনৌ থেকে সামরিক দফতর স্থানান্তরিত করার নির্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ এসেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো সুবিধা করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝলেন যে নারী, শিশু এবং রুগ্নদের স্থানান্তরিত করা এবং আলমগড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা অসম্ভব। সাহায্য না আসা পর্যন্ত তাঁকে আক্রমণ করার বদলে আত্মরক্ষাই করতে হবে-এ কথা তিনি হৃদয়ঙ্গম করলেন। খাদ্য সমস্যা নিয়ে তিনি সত্য সত্যই বিব্রত হয়ে পড়লেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাহায্য এসে পৌঁছলো। উদ্ধারকারী সৈন্যদল সঙ্গে করে প্রচুর রসদ নিয়ে এসেছে।
৭ই নভেম্বর তারিখে মেজর ব্রসের কাছ থেকে একখানা চিঠিসহ এলেন একজন দূত। চিঠিতে প্রকাশ স্যার কলিন ক্যাম্পবেলের অধীনে বিরাট সেনাদল যাত্রা করেছে, তারা তিনদিন সময়ের মধ্যে আলমবাগে এসে উপনীত হতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ১৮৫৭ সালের ১১ই জুলাই তারিখে স্যার কলিন ক্যাম্পবেলকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। সে সময়ে তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি বছর। হঠাৎ করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করেননি। তার আগে তিনি শাসনতান্ত্রিক এবং সাংগঠনিক পর্যায়ের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। ২৭শে অক্টোবর তারিখে তিনি কলকাতা থেকে যাত্রা করলেন। এলাহাবাদ থেকে বেনারস যাত্রা করার সময় সেপাইদের হাতে বন্দী হওয়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। এলাহাবাদে এসে তিনি জানতে পেলেন, আউটরাম হ্রাসকৃত রসদে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রধান সেনাপতি ৩রা নভেম্বরে কানপুর পৌঁছালেন। তিনি লখনৌ যাবেন নাকি কানপুরে যে গোয়ালিয়রের সেনাদল ভীতি প্রদর্শন করছে তাদের দমনে যাবেন, সে বিষয়ে প্রথমে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তিনি কানপুরে বেশি সৈন্য না রেখে লখনৌ যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন, সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে লখনৌর অনশনক্লিষ্টদের রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তিনি উইণ্ডহ্যামকে অল্প সংখ্যক সৈন্যসহ কানপুরে পাঠিয়ে দিলেন।