বিরজিস কাদিরের রাজ্যাভিষেকের পরে শহরবাসীদের উৎসাহ উদ্দীপনা বহুগুণে বেড়ে গেলো। ওদিকে ব্রিটিশ সৈন্য তাদের আরেকজন নায়ককে হারালো। তিনি হলেন চীফ ইঞ্জিনিয়ার মেজর এন্ডারসন। তিনি গুলির আঘাতে নয়, পেটের অসুখে ভুগেই মারা গেলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম করা এবং অবসর গ্রহণ না করার জন্যই জেনারেল এন্ডারসন মারা গেলেন। হ্যাভলকের দ্বিতীয় দফা পশ্চাদপসরণ তালুকদারদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে। দীর্ঘদিন যাবত তারা ওয়ালীকে সমর্থন না করে পারেন না। আগস্ট মাসে অবরোধকারী শত্রুর সংখ্যা বিশ থেকে চল্লিশ হাজার বলে জানা গেলো। কিন্তু জেনারেল এন্ডারসন পরে শুনেছেন, তাদের সংখ্যা পুরোপুরি এক লক্ষ।
আগস্ট মাসটা হচ্ছে পরিখা কাটার উপযুক্ত সময়। এ ব্যাপারে পাচিরা হলো ওস্তাদ। বৃষ্টিতে মাটি নরম হওয়ায় তাদের কাজও সহজ হয়ে এসেছিলো। ব্রিটিশ সৈন্য অভ্যন্তরের অত্যন্ত শঙ্কিতভাবে সময় কাটাচ্ছিলো। ১০ই আগস্ট তারিখে রেসিডেন্সী দ্বিতীয়বার ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হলো। বেলা এগারোটার পর থেকে গোলার পর গোলা ফুটতে আরম্ভ করলো। কর্ণেল ইঙ্গলিস অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। তার পাশে যে লোকটি ছিলো তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো। গোলার পর গোলার আঘাতে প্রাচীর স্থানে স্থানে ধ্বসে পড়লো। এ সময় বিদ্রোহীরা যদি ভালোভাবে চেষ্টা করতো তাহলে ভেতরে প্রবেশ করতে পারতো।
আগস্ট মাসেও অবরুদ্ধ ব্রিটিশ সৈন্যদের মাথার ওপর থেকে দুর্যোগের কালো মেঘ অপসারিত হলো না, যদিও তারা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তবুও বন্ধুদের আগমনবার্তা তারা শুনতে পাচ্ছে। ফিরতে এ্যানগাডের অনেকদিন লেগে গেলো। কিন্তু ১৫ই আগস্ট তারিখে তিনি কর্ণেল টাইটলারের কাছে থেকে দ্বিতীয় সংবাদ বয়ে এনেছেন। ৪ তারিখের চিঠিখানিতে হ্যাভলকের দ্বিতীয়বার লখনৌ উদ্ধারের প্রচেষ্টার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পথিমধ্যে এ্যানগার্ড শহস্তে পতিত হলেন। তিনি যখন শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেলেন, ততোদিনে পুনর্বার নদী অতিক্রম করে হ্যাভলক কানপুরে ফিরে গেছেন।
সেপ্টেম্বর মাসটি ছিলো ইংরেজদের জন্য অত্যন্ত ভাগ্যবন্ত মাস। এ মাসেই ঘটে দিল্লীর পতন এবং এ মাসেই লখনৌতে সাহায্য আসে। সাহায্য আসার পরেও কিন্তু অবরুদ্ধ অধিবাসীদের মুক্তি আসেনি। খাদ্য-বস্তু এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব রকম চড়ে গেছে। আটা, মদ, সিগারেট ভীষণ দুর্মূল্য হয়ে উঠেছে। মিসেস কেসি বলেছেন ৫ই সেপ্টম্বর তারিখে মহিলারা যখন নৈশ ভোজনে রত, তাদের কক্ষের একটা দেয়াল ধ্বসে পড়লো। সুতরাং মহিলাদেরকে অভূক্ত অবস্থাতেই কক্ষান্তরে যেতে হলো।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে শাহগঞ্জের প্রভাবশালী তালুকদার রাজা মানসিং বিপুল সৈন্য নিয়ে লখনৌর নিকটবর্তী স্থানে শিবির রচনা করেছেন। তার উপস্থিতিতে অবরুদ্ধদের মনে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হলো, তেমনি অন্যদিকে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন ভয়ানক ভাবে। যদি রাজা মানসিং ব্রিটিশ পক্ষে যোগ দেন, তাহলে অবরুদ্ধরা হয়তো বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে আর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলে সকলকে যে ভবলীলা সাঙ্গ করতে হবে, সে ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ রইলো না। ১৪ তারিখে ক্যাপটেন কালটন মাথায় গুলি লেগে মারা গেলেন। কালটনের মৃত্যুতে ইংরেজদের মনে গভীর বিষাদের সঞ্চার হলো, কিন্তু অনতিবিলম্বে সুখপ্রদ সংবাদ এলো। ১৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে এ্যানগাড একখানা চিঠিসহ আবার হ্যাভলকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রভুদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও লিখিত কোনো প্রমাণ নেই, এ্যানগার্ড একাধিকবার নালিশ করেছেন যে, বেষ্টনীর ভেতরের দেশীয় সেপাইদের সঙ্গে বাইরে সেপাইদের সংযোগ রয়েছে। সেজন্য শিবিরের সমস্ত খবর আগেভাগে সেপাইরা জেনে যায়। লেফটেন্যান্ট জেমস গ্রাহাম আত্মহত্যা করলেন। কিন্তু তা বিশেষ হতাশার সঞ্চার করতে পারেনি। অবরুদ্ধতার কারণে সাফল্যের সমস্ত আশা হারিয়ে ফেললো। এ্যানগাডের সংবাদও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো না হতাশাগ্রস্থ সৈন্যদের। কেউ তাঁর কথাকে আর বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিন্তু ২২ তারিখে তিনি খবর নিয়ে এলেন, উদ্ধারকারী সৈন্যদল আর বেশি দূরে নয়। এবার তিনি হ্যাভলকের কাছ থেকে নয়, জেনারেল আউটরামের কাছ থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছেন। ২৩ তারিখে কানপুরের দিকে দূরবর্তী বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেলো। ২৫ তারিখে হ্যাভলক এবং আউটরাম রেসিডেন্সীর মধ্যে প্রবেশ করলেন।
বিদ্রোহের সময় তিনি পারস্যে ছিলেন। তাঁকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে গভর্ণর জেনারেল প্রদেশগুলোর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ভয়ানক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। সে জন্য তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
আউটরাম এবং হ্যাভলক ছিলেন পুরোনো বন্ধু। হ্যাভলক পারস্যে আউটরামের অধীনে কাজ করেছেন। আউটরামের নিয়োগের ফলে হ্যাভলক ব্যথিত হলেন। কানপুর অভিযানে তিনি অবিমিশ্র সাফল্যের দাবিদার। তাঁর বিরুদ্ধে যতোই নালিশ থাকুক না কেননা, আউটরাম হ্যাভলকের সামরিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলেন না। আউটরাম ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে কানপুর পৌঁছলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চীফ অব ষ্টাফ। মগডালার লর্ড ন্যাপিয়ের ছিলেন একজন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশীল পুরুষ। ৮ তারিখে ভাসমান ব্রিজ অতিক্রম করা হলো। পরের দিন সেনাবহিনী আবার লখনৌ অভিমুখে মার্চ করতে লাগলো। এবারে তাঁরা লখনৌতে এসে পৌঁছালেন। এ বাহিনীতে ২৭৯৯ জন সশস্ত্র ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো। তাদের মধ্যে দেশীয় সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো ৪০০ জনের মতো। তার মধ্যে ৩৪১ জন ছিলো শিখ। তারা মঙ্গলওয়ারে প্রথম বাধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু এ সময়ে উনাও কিংবা বশিরাতগঞ্জে তাদের যুদ্ধ করতে হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, সাইয়ের কাছে বান্নী ব্রিজে তাদেরকে কোনো বাধাই দেয়া হয়নি। ব্রিটিশ সেনাপতিরা এরকম সৌভাগ্য আশা করেননি। তাঁরা ২৩ তারিখে লখনৌর কাছাকাছি আলমবাগে এসে পৌঁছালেন। সেখানে তারা প্রবল বাধার সম্মুখীন হলেন। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলো এবং লখনৌর পথ পরিষ্কার হয়ে গেলো।