একে তো যুদ্ধের গতি ভালোর দিকে। ২২ তারিখে আরো ভালো খবর এলো। ২৯ তারিখে এ্যানগাড কানপুর ত্যাগ করেছেন। তিনি ফিরেছেন ২২শে জুলাই। তাঁর সঙ্গে কোনো লিখিত নির্দেশ নেই। যে নির্দেশ তাকে দেয়া হয়েছিলো তিনি তা পথে হারিয়ে ফেলেছেন। তবে তিনি নানার সেনাবাহিনীর উপর হ্যাভলকের বিজয়ের অবিশ্বাস্য সংবাদ বয়ে এনেছেন।
উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে কয়েকদিন আকাশের দিকে তাকাতে থাকলেন। কিন্তু সাহায্যকারী বাহিনীর কোনো হাউই সঙ্কেত দেখতে না পেয়ে তারা নিরাশ হয়ে গেলেন। দিনের পর দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে। শিবিরের লোকজনের মনোবল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।
জুলাইয়ের শেষের দিকে আহত মানুষে হাসপাতাল ভর্তি হয়ে গেলো। রক্তাক্ত আহত মানুষ বিছানায়, কৌচে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। হাসপাতালের সেবক এবং পরিচারকের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। সকলকে সেবা করার সময় এবং সুযোগও নেই।
উল্কণ্ঠিত চিত্তে অবরুদ্ধ ব্রিটিশ সেনা যখন দিন যাপন করেছিলেন, হ্যাভলকও বসে সময় কাটাননি তখন। ১৭ জুলাই তারিখে তিনি কানপুর এসে পৌঁছেছেন। ২০ তারিখে তাঁর কিছু সৈন্য অযোধ্যার অংশে নদী অতিক্রম করলেন। ২৫ তারিখের মধ্যে নদী পার হওয়ার কাজ শেষ হলো এবং জেনারেল নিজেও সেনাদলের সঙ্গে যোগ দিলেন। ২৬ তারিখে তিনি লখনৌ থেকে ৫ মাইল দূরে মঙ্গলওয়ার নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলেন। তিনদিন পরে উনাও নামক স্থানে তাঁর অগ্রগতি বাধার সম্মুখীন হলো। ঘোরতর যুদ্ধের পর তিনি সেপাইদের তাদের সুরক্ষিত স্থান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। প্রাচীর ঘেরা শহর বশিরাতগঞ্জে তারা বিজয়ী শত্রুকে প্রচণ্ডভাবে বাধা দিলো। দ্বিতীয়বারেও হ্যাভলক জয়লাভ করলেন। কিন্তু এজন্য তাঁকে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি অবরোধ করলেন। দানাপুরে বিদ্রোহের সংবাদ শুনে তার দলের লোকেরা বিচলিত হয়ে উঠলেন। কলকাতা থেকে সাহায্য পাবার পূর্বেই বিদ্রোহীরা প্রত্যেক ঘাঁটিতে দৃঢ়চিত্তে তাঁকে বাধা দিতে লাগলো। টাইটলার শত্রুদের শক্তি এবং দৃঢ়তা সম্বন্ধে খুব নাজুক ধারণা পোষণ করেছিলেন। যারা তাকে বাধা দিচ্ছিলো, তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য উপযুক্ত শক্তি তার ছিলো না। তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, তার ফলে তার সৈন্যদলকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তিনি মঙ্গলওয়ারে ফিরে গিয়ে কলকাতা থেকে সৈন্য না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন।
আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে হ্যাভলক অল্পসংখ্যক সৈন্য সাহায্য পেয়ে লখনৌর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। তাঁর ফিরে আসার সুযোগে সেপাইরা বশিরাতগঞ্জ পুনরায় দখল করে নিয়েছে। তিনি বশিরাতগঞ্জের সেপাইদেরও পুনরায় পরাজিত করলেন। কিন্তু শীগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠেলো যে লখনৌকে মুক্ত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী তিনি নন। এখন প্রশ্ন হলো অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তিনি ঝুঁকি গ্রহণ করবেন, নাকি কর্ণেল ইঙ্গলিসকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করবেন? তার সৈন্যের পতন লখনৌর পতনকে ত্বরান্বিত করবে। পক্ষান্তরে তিনি যদি অপেক্ষা করেন এবং সেনাদলকে অক্ষত রাখেন, সেপাইদের কোনো ভুলের সুযোগ গ্রহণ করে হয়তো ইতিমধ্যে অবরুদ্ধদের মুক্ত করার কোনো পন্থা বের করতে পারবেন। বশিরাতগঞ্জে পরাজয় বরণ করার পরেও সেপাইরা কিন্তু নিরুত্সাহী হয়ে পড়েনি। পরাজয় বরণ কররার পূর্ব পর্যন্ত বুরিয়াকা চক নামক স্থানে তাঁকে আবার আরেকটি যুদ্ধ করতে হলো। ইতিমধ্যে তিনি সংবাদ পেলেন প্রবল বিদ্রোহী সৈন্যের মোকাবেলায় কানপুর এবং বিরের পতন আসন্ন হয়ে এসেছে।
আগস্ট মাসটি হলো লখনৌর অধিবাসীদের জন্য চরমতম দুঃসময়ের কাল। তারা প্রাথমিক সাহায্যের সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যর্থতা তাদেরকে এতোদূর সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে যে তারা হ্যাভলকের বিজয়ের সংবাদও বিশ্বাস করতে পারলেন না। রসদের পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমে এসেছে। মোটা আটা, মাষকলাইয়ের ডাল ছাড়া তাদের খাবার মতো অন্য কোনো জিনিস নেই। খাদ্যের অভাবের চাইতে আফিমের অভাব আরো গুরুতরভাবে অনুভূত হতে লাগলো।
আগস্ট মাসের ১১ তারিখে রেসিডেন্সীর ছাদ ধ্বসে পড়লো। ৩২নং রেজিমেন্টের অর্ধডজন মানুষ ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়লো। তাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে বের করে আনা হলো। কেবলমাত্র এক জনকেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছিলো। ২৩ তারিখে রেসিডেন্সীর পেছনের বারান্দা ধ্বসে পড়লো। কিন্তু তাতে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ওই আগস্ট তারিখে অবরোধকারীরা ঘোষণা করলো যে তাদের রাজার রাজ্যাভিষেক হয়ে গেছে। ফিরিঙ্গি রাজত্বের অবসান হয়েছে। বিদ্রোহী সেপাইদের জন্য এমন একজন আনুষ্ঠানিক শাসকের প্রয়োজন, যার আহ্বানে তারা সকলে সমবেত হতে পারে। প্রকৃত নওয়াব কলকাতাতে বন্দী জীবন যাপন করছেন। কাজেই সেপাইরা তাঁর নাবালক পুত্রকে তাদের শাসক নির্বাচিত করলেন। তার নির্বাসিত পিতা দিল্লীর অধীন ছিলেন না। তাঁর রাজত্বের একটা নতুন দিক হলো তিনি, অথবা অধিকতরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তার উপদেষ্টারা দিল্লীর সম্রাটের যাবতীয় আদেশ মেনে চলবেন। অধিকতরা দায়িত্বশীল সেপাই নেতৃবৃন্দ আনুগত্যের মাধ্যমে সংহতি আনয়ন করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। রাষ্ট্রের যাবতীয় দায়িত্বশীল পদ হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হলো। শরফুদ্দৌলাকে প্রধান মন্ত্রী এবং মহারাজ বালকিষাণকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করা হলো। মাম্মু খানকে প্রধান বিচারক এবং জয়লাল সিংকে সমর মন্ত্রীর পদ দান করা হলো। নাবালক ওয়ালী বিরজিস কাদিরের জননী বেগম হজরত মহল সমস্ত ক্ষমতা পরিচালনা করবেন।