অবরোধকারী সেপাইদের পুরোপুরি সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ইনস মনে করেন, দু’টি নিয়মিত রেজিমেন্ট, অষ্টম অযোধ্যা স্থানীয় রেজিমেন্ট, ১৫ নং নিয়মিত রেজিমেন্ট, গোলন্দাজ বাহিনীর পুরো দুটি দল, অন্যান্য অশ্বারোহী বাহিনী এবং অযোধ্যার তালুকদারদের তিনটি দল বিদ্রোহী অবরোধকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। স্যার হেনরী লরেন্স প্রথমে অযোধ্যার তালুকদারদের সমর্থন লাভ করতে চেষ্টা করলেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন শাহূগঞ্জের রাজা মানসিং। তিনি ইংরেজদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করলেন। কিন্তু রামগড়ের হিন্দুরাজা গুরুবক্স এবং মাহমুদাবাদের মুসলিম ভূস্বামী নওয়াব আলী কঠোর জবাব দান করলেন। জুলাই মাসে তাঁদের সৈন্যদল লখনৌর বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলো। প্রথমদিকে রেসিডেন্সীর দেয়াল ভাঙ্গার কোনো প্রচেষ্টাই সেপাইরা করেনি। রেসিডেন্সীর অভ্যন্তরস্থ নিবাসসমূহই ছিলো সেপাইদের গোলাগুলির নিশানা। কথিত আছে, বরকত আহমদ নামে ১৫নং অশ্বারোহী বাহিনীর একজন অফিসার সেপাইদের নেতৃত্বদান করেছিলেন, মাহমুদাবাদের রাজার লেফটেন্যান্ট খান আলী খান, তালুকদারদের বাহিনীতে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।
স্যার হেনরী লরেন্স অনুভব করলেন, এখন মচ্ছি-ভবন ত্যাগ করে সেনাবাহিনীকে রেসিডেন্সীতে নিয়ে আসাই উত্তম হবে। পরিত্যক্ত ঘাঁটি ছিলো কর্ণেল পামারের অধীনে। রেসিডেন্সীর ছাদের যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছিলো। অবিরাম গোলাবর্ষণের মুখে দু’জন অফিসারকে ক্যাপটেন কালটন খবর দিতে সক্ষম হলেন, বন্দুকগুলো ভালোভাবে রক্ষা করো, দুর্গ উড়িয়ে দাও, তারপরে মধ্যরাতের দিকে পালিয়ে এসো। অধিকতর ক্ষয়ক্ষতির পূর্বে নির্দেশ পালন করা হয়েছিলো। তবে ভাণ্ডারের অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে আসতে হলো। সকাল বেলা ১টার মধ্যে সেপাইরা ঘেরাও করার কাজ শেষ করে ফেলেছে।
সকাল হওয়ার একটু পরেই স্যার হেনরী লরেন্স সবগুলো ঘাঁটি পরিদর্শন করতে গেলেন। সবকিছু নিজের চোখে দেখার পর তিনি রেসিডেন্সীতে নিজের কক্ষে এসে রেশন বণ্টন সম্বন্ধে একখানা নির্দেশ লিখিয়ে নিচ্ছিলেন। তার আগের দিন তাঁর কক্ষে গুলি এসে পড়েছিলো কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। সকলে তাঁকে সে কক্ষ ছেড়ে অধিকতররা নিরাপদ কক্ষে চলে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিলো। তিনি পরের দিন চলে যাবেন বলে স্থিরও করেছিলেন। শত্রুদের মধ্যে এমন অব্যর্থ লক্ষ্য মানুষ আছে সেকথা তিনি চিন্তাও করতে পারেননি। যা আশাও করতে পারেনি কেউ তাই ঘটে গেলো। ক্যাপটেন উইলসন আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ধূলো এবং ধূয়ার জন্য উইলসন কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন “স্যার হেনরী, আপনি কি আহত হয়েছেন?” একটু পরেই এলো অস্ফুট চীৎকার “আমি মারা গেলাম।” ডঃ ফেরারের গৃহে স্যার হেনরী লরেন্সকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তিনি ৪ তারিখে মারা গেলেন। তিনি মেজর ব্যাঙ্কসকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন এবং তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্দেশ দান করলেন।
৩রা জুলাই তারিখে বিচার বিভাগীয় এম. এম. ওম্যানির মস্তকে গোলার আঘাত লাগলো এবং দুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে নতুন চীফ কমিশনার মেজর ব্যাঙ্কসও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারলেন না। গাবিন্সের ঘাঁটিতে তিনিও ২১শে জুলাই তারিখে মস্তকে গুলিবিদ্ধ হলেন। এভাবে এক সপ্তাহকাল সময়ের মধ্যে চীফ কমিশনারের আসন দু’দুবার খালি হলো। ব্রিগেডিয়ার ইঙ্গলিস স্থির করলেন, সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রতিরক্ষার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর গ্রহণ করা উচিত। তারপর থেকে শিবিরে বেসামরিক কর্তৃত্বের অবসান ঘটলো। অহরহ মৃত্যু ঘটছে। মিসেস ডোরিন নামে সীতাপুরের এক আশ্রয় প্রাথিনী গাবিন্সের ঘরের জানালা দিয়ে আসা একটি গুলির আঘাতে নিহত হলেন।
জুলাইয়ের পয়লা দিকে প্রকৃতি ব্রিটিশ পক্ষের সহায়ক হলো। ৫, ৭ এবং ১০ তারিখে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টির পানি অনেক ময়লা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, আবহাওয়া পরিষ্কার করে তুলেছে। ৭ তারিখে বৃষ্টি স্বাস্থ্যকর অবস্থা সৃষ্টি ছাড়াও যে সুযোগ দিয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। হাসপাতালের কামানের সামনে প্রচুর পরিমাণ ভুষি রাখা হয়েছিলো জমা করে। কতিপয় সাহসী সৈনিক এ ভূষির স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিলো। ভীষণ দাহ্য ভূষিতে আগুন লাগানোর পরেও সময়মতো বৃষ্টির জন্য অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়নি।
পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে অবরোধকালে মহিলাদেরকেও অনেক দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তয়খানা অথবা ভূগর্ভস্থ কক্ষে ইঁদুর বেড়ালের সঙ্গে তাঁদের কাটাতে হয়েছে। রসদের ঘাটতি পড়েছে। চারদিকে গুমোট অবস্থা। সকলের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।
মিঃ রীস ধারণা করতে পারেন না যে এতো সকালে লখনৌ শহরের পতন ঘটবে। কিন্তু অতিসত্বর কোনো সাহায্যের প্রত্যাশাও তিনি করতে পারছেন না। সকলেই বলছে, সাহায্য আসছে, কিন্তু কোথায় সেই সাহায্য? কোত্থেকে আসছে? কখন আসছে? কানপুর শত্রুর অধিকারে চলে গেছে। সমগ্র ভারত জুড়ে দেখা দিয়েছে বিশৃঙখলা।
সুদীর্ঘকাল ধরে রেসিডেন্সী অবরোধকালে সেপাই নেতৃবৃন্দ মাত্র চারবার ব্যাপকভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। ২০শে জুলাই তারিখে তারা প্রথমবারের মতো আক্রমণ করেন। কামানের নিকটের একটি গোলা বিস্ফোরিত হলো, কিন্তু তার ফলে কামানের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ দূরত্ব সম্বন্ধে সঠিক ধারণা তারা পোষণ করতে পারেনি। তারপরে সেপাইরা চতুর্দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো। ধীরস্থির সুসংহত গতিতে তারা এগিয়ে আসছিলো। কোনো সুদক্ষ ইউরোপীয় অফিসার তাদেরকে নেতৃত্ব দান করেছিলো বলে সন্দেহ করা হয়। ব্রিটিশ পক্ষও সমান দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরক্ষা করে চলেছে। দলে দলে সেপাই সৈন্য এগিয়ে আসে কিন্তু তাদের নেতৃবৃন্দ ভেতরে প্রবেশ করতে অপারগ। যুদ্ধ শুরু হয় সকাল নটায় এবং চার ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। তারপরে অবরোধকারীরা চলে যেতে বাধ্য হয়। শত্রুদের তুলনায় সেপাইদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। ব্রিটিশ পক্ষে ২৩জন হতাহত হয়েছে, তার মধ্যে ১৪ জন হলেন ইউরোপীয় ।