কতেক ব্যাটারী এখনো স্থাপন করা হয়নি। শ্রমিকেরা রাত-দিন পরিশ্রম করছে। মজুরী অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। একজনের মজুরী যেখানে প্রতিরাতে দু’আনা, সেখানে স্যার হেনরীকে প্রতিরাতে দু’টাকা পর্যন্ত মজুরী দিতে হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ মজুরদের বিশেষ লাভ হয়নি। ঘেসুড়ে, গৃহভৃত্য, ঝাড়ুদার সকলেই অধিক মজুরীতে কাজ করতে লেগে গেলো। অবরোধের সময়ে কিছু চাকর প্রভুদের সঙ্গে ছিলো।
গবাদি পশু তাদের বর্ধিত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। দেখাশোনা করার কোন চাকর-বাকর ছিলো না এবং আশেপাশে কোথাও ঘাস ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছিলো না। কতেক পশু কুয়ার জলে ঝাঁপ দিয়ে জল বিষাক্ত করে তুললো। অন্যান্য প্রাণী গুলির আঘাতে প্রাণ দিয়ে বাতাস দুষিত করলো।
প্রত্যেক পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা রান্না-বান্না করা অসম্ভব হয়ে পড়লো। পুরুষ মানুষেরা প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সময়ে সময়ে মাত্র তারা স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে পারে। শিশু এবং নারীদের তয়খানা অথবা ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় দেয়া হলো। কারণ গুলি-গোলার আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার জন্য সেটাই ছিলো সবচেয়ে প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা। অনেকগুলো পরিবার এক সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই কলেরা বসন্ত ইত্যাদি মহামারী দেখা দিলো। রেসিডেন্সীতে অনেকগুলো পরিবার আশ্রয় পেয়েছিলো। তাছাড়া আরো কতিপয় পরিবার ডঃ ফেরিয়ার এবং মার্টিন গাবিনসের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো। মার্টিন গাবিস আসন্ন অবরোধের আশঙ্কা করে ভাণ্ডারে প্রচুর খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তাই অবরোধের সময় তাদেরকে অন্যান্যদের মতো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
অবরুদ্ধ মানুষদের মধ্যে ছিল সকল শ্রেণীর মানুষ। সরকারি চাকুরে, কেরাণী, ব্যবসায়ী-সব রকমের মানুষ ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এখন সকলকেই অস্ত্র ধরতে হচ্ছে। সমস্ত ইউরোপীয় অধিবাসী আবার ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা নন। এমন একজনও ইউরোপীয় ছিলো না, বিদ্রোহের সময়ে যিনি গ্রেফতার হননি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিদ্রোহীদের গুলিতে হতাহত হলেন।
অবরোধের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভ্রান্ত ভারতীয়দের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক করে রাখা হলো। তাঁদের প্রধান ছিলেন মোস্তাফা আলীখান। তিনি ছিলেন নওয়াব ওয়াজেদ আলী শাহের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন বলে তাঁর পিতা তাঁকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেন। দিল্লীর সম্রাটের বংশোদ্ভুত দু’জন রাজপুরুষ মীর্জা মুহম্মদ হুমায়ুন এবং মীর্জা মুহম্মদ শিকোহ্ যারা লখনৌ দরবারের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁদেরও বন্দী করে রাখা হলো। মুসলিম সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাথে হিন্দু তালুকদার, জমিদার এবং রাজাদেরও বন্দী করা হলো। তাদের মধ্যে তুলসীপুরের অল্পবয়স্ক রাজাও ছিলেন। এ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মচ্ছি-ভবনে স্থান দেয়া হয়েছিলো।
অবরোধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পক্ষ গোয়েন্দার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে, কেননা ছাউনির সঙ্গে তাবৎ জগৎ সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে। ছদ্মবেশে মেজর গল এলাহাবাদ যাওয়ার চেষ্টা করে বিফল হলেন। সেপাইদের হাতে ধৃত হয়ে তিনি নিহত হলেন। গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা ছিলেন গাবিন্স। তার অধীনে বিশ্বস্ত এবং সুদক্ষ কতিপয় গোয়েন্দা কাজ করছিলো। কিন্তু সেপাই বেষ্টনী ভেদ করা খুব সহজ ছিলো না।
রেসিডেন্সীর উত্তর দিকে গোমতী নদী অবস্থিত। সেদিক দিয়ে অবরোধকারীদের একক হামলা করার জন্য প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করার স্থান ছিলো। নিরাপদ দূরত্ব থেকে গোলাবর্ষণ করে-দুর্গ প্রাকারও তারা ভেঙ্গে ফেলতে পারতো। দক্ষিণে কানপুর সীমান্ত, পশ্চিমদিকে শহর এবং প্রহরীরা রেসিডেন্সীর পূর্বদিক রক্ষা করে আসছিলো। রণাঙ্গনের মধ্যবর্তী অট্টালিকাগুলো গোলার আক্রমণ ব্যর্থ করে দিচ্ছিলো এবং অধিকসংখ্যক সৈন্যের সাহায্যে আক্রমণও অসম্ভব করে তুলেছিলো। উত্তরের রণাঙ্গনের কেন্দ্রবিন্দুতে কামান পাতা হয়েছে, দক্ষিণ প্রান্তে ইনসের ঘাঁটি এবং একবারে পূর্বদিকে হাসপাতাল ঘাঁটি। তার পাশে হলো বেইলী গার্ডদের অবস্থান। একটু দূরে দক্ষিণে পূর্ব কোণে কানপুর গোলন্দাজ বাহিনী এবং মার্টিন গাবিন্সের বাড়িতে এন্ডারসনের ঘাঁটি। চীনহাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে উত্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোটেই জোরদার করা সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ দিকটা অপেক্ষাকৃতভাবে নিরাপদ ছিলো। বিদ্রোহীরা সীমানার কাছাকাছি এসে যায়। অবরোধকারী সেপাইরা অবরুদ্ধ শিখ সেপাইদের সঙ্গে হামেশা কথাবার্তা বলতো। কিন্তু সমগ্র দক্ষিণ দিকে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিলো, তার ফলে সেপাইরা অগ্রসর হতে পারছিলো না এবং কামানের গোলাবর্ষণ থেকে অট্টালিকার নীচের দিক রক্ষা পেয়েছিলো। পূর্বদিকে হাসপাতাল এবং এন্ডারসনের ঘাটির মাঝখানে পেছনের সারিতে ডঃ ফেয়ারের বাড়ি। সামনের সারিতে বেইলী গার্ড, স্যান্ডার্স এবং ফ্যাগোর ঘাটি। এই লাইনের উত্তর-পূর্ব দিক অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিলো। পশ্চিম প্রান্তে অথবা নগরের দিকে গাবিন্স এবং ইনসের ঘাঁটির মধ্যবর্তীস্থানে কসাইখানা, বকরীঘর এবং রেসিডেন্সীদের চাকর বাকরদের নিবাসকেন্দ্র। তা ছাড়া রয়েছে গীর্জা, খ্রীস্টান গোরস্থান এবং ইভানের কামান। বলতে হয়, সবদিক দিয়ে রেসিডেন্সী সুরক্ষিত ছিলো। অনুগত সেপাইরা চারটা ঘাঁটি পুরোপুরিভাবে রক্ষা করে আসছিলো। অবরুদ্ধ অধিবাসীদের সংখ্যা ছিলো ৩ হাজার। তার মধ্যে ১৭২০ জন ছিলেন যোদ্ধা। বাকী ১২৮০ জন ছিলেন শরণার্থী। সমস্ত সৈন্যের অর্ধেক ছিলো ভারতীয়। সেপাই ছাড়া আরো ৬৮০ জন ভারতীয় ছাউনির মধ্যে ছিলো। নিকটবর্তী উচ্চ অট্টালিকা হতে সুরক্ষিত দুর্গে রাইফেলের গুলি ছোঁড়া হতো।