এর পাঁচ বছর পরে হিন্দু সেপাইদের মধ্যে গোঁড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন সম্প্রদায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার মধ্যে ব্রিটিশের ধর্মবিরোধী ভূমিকা আবিষ্কার করলো। সমস্ত মানবিক নীতি বহির্ভূত এ প্রথাটি অনেকদিন আগেই রহিত করার প্রয়োজন ছিলো, এ কথা কে অস্বীকার করবে? প্রথম দিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশীয় হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিলো। কারণ তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি কোম্পানীর রাজ্যসীমার মধ্যে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। তাই বলে, কোনো সুসভ্য শাসন ব্যবস্থা কি এ প্রথা রহিত না করে পারে? বোর্ডের পরিচালকেরা ধর্মের নামে এভাবে জীবন্ত মানুষ দগ্ধ করার প্রথা বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। লর্ড আমহার্স্ট ঠিকই ধরেছিলেন, যে কোনো সংস্কার তা যতোই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, তার ফলে অসন্তোষের সৃষ্টি হতে পারে। তাই সতীদাহ প্রথা রহিত করতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কই এ অমানবিক প্রথা বন্ধ করার সবটুকু কৃতিত্বের যোগ্য দাবিদার। তিনি সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন বলেই এ প্রথা বন্ধ হয়েছিলো। লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহকে প্রাণদণ্ডনীয় অপরাধ বলে আইন করে দিলেন। তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। তারা সংখ্যায় অত্যন্ত স্বল্প। ধর্মোন্মত্ত মানুষেরা এর পেছনে শাস্ত্রের সমর্থন রয়েছে বলে এ আইনের বিরুদ্ধে প্রচার কাজ চালাতে থাকে। ইংরেজের এ প্রশংসনীয় সংস্কারটিকেও পরবর্তীকালের বিদ্রোহী নেতারা মূলধন করেছিলো। খান বাহাদুর খান তাঁর এক ফরমানে বলেছেন, হিন্দু কুলবধূদের মৃত স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে গমন করা একটি সুপ্রাচীন ধর্মীয় প্রথা। ইংরেজরা তা রহিত করে নিজেদের আইন জারী করেছে। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার ফলে হিন্দু প্রজাদের মধ্যে শুধু অসন্তোষের সৃষ্টি হয়নি, মুসলমানেরাও সমানভাবে বিক্ষুব্ধ হয়েছে। আজকে হিন্দুর ধর্মে আঘাত করেছে। আগামীকাল মুসলমানের ধর্মেও আঘাত করতে পারে।
রাত্রে (Rattray) র শিখ সেপাইদলের সুবাদার সর্দার বাহাদুর হেদায়েত আলীর কথাতেই তার সমর্থন পাওয়া যাবে। তিনি ছিলেন রাজভক্ত সেপাই। তার বাবা এবং বাবার বাবাও সেপাই হিসেবে পল্টনে জীবন কাটিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর রাজভক্তি যে সকল রকমের সন্দেহের অতীত এ রকম বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সরকারের কাছে তিনি বাঙালি পল্টন এবং বাংলা প্রেসিডেন্সীতে সৈন্যদলের মধ্যে অসন্তোষ, বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহের কারণ নির্দেশ করেছেন অল্প কথায়। এর জন্য তিনি আফগান যুদ্ধকেই দায়ী করেছেন। আইনানুগ পদ্ধতিতে সেপাইরা কাবুল যেতে অস্বীকার করতে পারলো না। অথচ তাদেরকে ভারতের বাইরে যেতে হচ্ছে, সেখানে গেলে তাদের জাতকুল রক্ষা হবে কিনা সে কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলো। কাবুলে হিন্দু সেপাইরা নিয়মিত সন্ধ্যা আহ্নিক এবং স্নান ইত্যাদি করতে পারতো না। দু’বেলা মুসলমানদের দোকান থেকে খাদ্যবস্তু ক্রয় করতে হতো। ভারতে তা ছিলো রীতিবিরুদ্ধ। কাবুলের যুদ্ধে অনেক সেপাই বন্দী হলো এবং জোর করে তাদেরকে মুসলমান বানানো হলো। দেশে ফিরে এসে দেখে তারা জাতিচ্যুত হয়ে গেছে। স্ব সমাজের কোথাও আর তাদের স্থান নেই। অজ্ঞ গ্রামবাসীরা তাদের সঙ্গে এক সাথে বসে তামাক খেতে পর্যন্ত রাজী ছিলো না। শুধু গ্রামবাসী নয়, সেপাই ভাইরাও কেউও তাদের সঙ্গে আহার করতে রাজী হলো না। মুসলমানদের ওসব সংস্কারের বালাই নেই। কিন্তু আপন ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে স্বভাবতঃই তাদের প্রবৃত্তি ছিলো না। হেদায়েত আলী বলেছেন, মুসলমান সেপাই পল্টনে গর্ব করে বেড়াতে কিভাবে ইংরেজের আদেশ অবহেলা করে বন্দুক ছোঁড়া থেকে বিরত ছিলো।
সীতারাম নামে এক হিন্দু সুবাদারকে চরম লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তার চাচা ছিলেন জমাদার। সীতারামের নিজের ছেলেও পল্টনে সেপাইর চাকুরি করতো। বিদ্রোহের সময় ছেলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু সীতারাম নিমক হারামি করতে পারেনি। বিদ্রোহ দমন করার পর তার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়। আপন সন্তানকে বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করার ভার পড়ে সীতারামের উপর। পরে অবশ্য এক দয়ালু অফিসার এ অমানবিক কর্তব্য থেকে তাকে রেহাই দেন।
সীতারাম আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর হিন্দু সহকর্মীদের মনোভাব সম্বন্ধে যা লিখে রেখে গেছেন, তা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। তিনি লিখেছেন, সেপাইদের মধ্যে আফগানিস্তান গমন করার প্রশ্নে প্রচণ্ড আতঙ্কের সঞ্চার হয়। সিন্ধু নদ অতিক্রম করার কথা শুনে তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠে। এমনকি গুজব উঠলো যে, কাবুলে সরকারের সৈন্যরা গো-হারা হারবে। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো ইংরেজরা কাবুল দখল করে নেবে। সে যাকগে, সিন্ধু নদ অতিক্রম করার কথা শুনে সেপাইরা ভীত হয়ে পড়লো। তাহলে তাদেরকে ভারতের বাইরে যেতে হবে এবং তার ফলে তারা জাতিচ্যুত হবে। এ কারণে সেপাইদের অনেকেই চাকুরি ছেড়ে দিলো, অনেককেই বরখাস্ত করা হলো। দুস্তর মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তাদের যাত্রা করতে হলো। কান্দাহার গিরিপথের পাশে এক পাপপূর্ণ দেশে তাদের অবস্থান করতে হলো। সেখানে তারা নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলো। একজন মারা গেলে দাহ করার জন্য কোনা জ্বালানী কাঠ পাওয়া গেলো না এবং ভাসিয়ে দেবার মতো পবিত্র গঙ্গাও সেখানে নেই। কাশীও অনেক দূরে। হিন্দু সেপাইদের দুর্দশার সীমা রইলো না। মৃতদেহ শৃগাল এবং গৃধিনীদের ভক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো।