জুনের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সমস্ত অযোধ্যা প্রদেশে ব্রিটিশ শাসনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। কিন্তু লখনৌ শহর এখনো তাদের জন্য ভোলা রয়েছে এবং দূরবর্তী ঘাঁটিসমূহ থেকে আশ্রয়প্রার্থীরা এসে সে শহরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পরেই স্যার হেনরী ক্যান্টনমেন্ট থেকে রেসিডেন্সিতে তাঁর সদর দফতর স্থানান্তরিত করলেন। তখন তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ছিলো না। তখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অপরিসীম দায়িত্ববোধ তাকে অযোধ্যাতে নিয়ে এলো। উৎকণ্ঠিত অবস্থায় তিনি গভর্ণর জেনারেলের কাছে টেলিগ্রাফ করলেন, বর্তমানের গোলমালে যদি আমার খারাপ কিছু ঘটে, আমি আন্তরিকভাবে সুপারিশ করছি, মেজর ব্যাঙ্কসকে চীফ কমিশনার হিসেবে যেনো আমার স্থলে মনোনীত করা হয়। সুদিন না আসা পর্যন্ত কর্ণেল ইনগলিসকে যেনো সেনাদলের কর্তৃত্বদান করা হয়। উপরঅলার আদেশ যথাযথভাবে মেনে চলার সময় এখন নয়। তারা হলেন একমাত্র উপযুক্ত মানুষ। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সেক্রেটারী পুরোপুরি একমত। এ পর্যন্ত যে অবসর তিনি গ্রহণ করেননি তা গ্রহণ করার জন্য তাঁর চিকিৎসকেরা চাপ দিতে লাগলেন। পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি অস্থায়ী কাউন্সিল গঠন করা হলো। সে সদস্য পাঁচজন হলেন-অর্থনৈতিক কমিশনার মার্টিন গাবিন্স, বিচার বিভাগীয় কমিশনার মিঃ ওম্যানি, মেজর ব্যাঙ্কস, কর্ণেল ইনগলিস এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ার মেজর এন্ডারসন। স্বভাবতঃই মার্টিন গাবিন্স কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেপাইদের নিরস্ত্র করার তাঁর প্রিয় প্রস্তাবটি তুলে ধরলেন। তাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হলো। তবে অল্প দিনের ছুটিতে সকলকেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তাঁর নীতির পরিবর্তন করার সঙ্গে সঙ্গেই হেনরী লরেন্স আবার তার কর্তব্যকর্মে যোগ দিলেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে কাউন্সিল বাতিল ঘোষণা করলেন এবং যে সকল সেপাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো, তাদেরকে ডেকে আনলেন। সেপাইদের অনেকেই ফিরে এলো এবং অবরোধকালীন সময়ে তারা যথেষ্ট বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে।
৩০ এবং ৩১শে মে তারিখের বিক্ষোভ সম্বন্ধে অনুমান করা হয়েছিলো। ৩১শে মে তারিখের একটা ধর্মীয় বিক্ষোভ পুলিশ দমন করেছিলো। দশ দিন পরেই সেপাইরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। স্যার হেনরী একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে প্রতিরক্ষার কাজ করে যেতে লাগলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্ট এবং মচ্ছি-ভবন খালি করে সকলে রেসিডেন্সীতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। উত্তরে এবং দক্ষিণে ব্যাটারী স্থাপন করা হলো। সুন্দর সুন্দর সুশোভিত বৃক্ষরাজি কেটে ফেলা হলো, পরিখা খনন করা হলো। সামরিক স্টোরের সরঞ্জামপত্র শান্তভাবে মচ্ছি-ভবন থেকে রেসিডেন্সীতে সরিয়ে দেয়া হলো। স্যার হেনরী সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখাশোনা করতে লাগলেন।
ব্রিটিশ জনসাধারণের সৌভাগ্য যে স্যার হেনরী প্রস্তুতি গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ এবং সময় পেয়েছিলেন। এভাবে জুন মাস কেটে গেলো। অযোধ্যার সামরিক এবং বেসামরিক ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটতে থাকে একের পর এক। এমনকি যেখানে কোনো সামরিক ঘাঁটি ছিলো না, সেখানকার বেসামরিক কর্মচারিদেরও সময় মতো ঘাঁটি ত্যাগ করার নির্দেশ দান করা হয়েছিলো। কিন্তু লখনৌর অবস্থা করুণ হয়ে এসেছে। কিন্তু স্যার হেনরী নিশ্চিত যে বিপদ নিশ্চিতভাবেই আসবে। যতোই দেরী হবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার অধিক সুযোগ তিনি পাবেন। জেনারেল হুইলার যে অবরুদ্ধ হয়েছেন, তিনি সে খবর পেয়েছেন এবং তিনি যথার্থই অনুমান করেছেন যে লখনৌ হবে সেপাইদের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য। আটাশ তারিখে শহর থেকে বিশ মাইল দূরে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে সেপাইরা জড়ো হলো। তড়িৎগতিতে ব্রিটিশ সেনাদলকে মচ্ছি-ভবন এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে রেসিডেন্সীতে নিয়ে আসা হলো।
তারপরের কর্তব্য কি-এ ব্যাপারে চিন্তা করতে লাগলেন। ছাউনির মধ্যে আবদ্ধ থেকে শত্রুর মোকাবিলা করা উচিত, নাকি শহরের বাইরে গিয়ে শত্রুদেরকে বাধা দিলে ভালো হয়, সে সম্বন্ধে কিছুই স্থির করা হয়নি। একটি বিজয় যদি অর্জন করা যায় তাহলে তার লোকজনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে এবং তাদের মধ্যে নতুন মনোবলের সঞ্চার হবে। দোদুল্যমান চিত্তের স্থানীয় মানুষেরাও তার ফলে নিশ্চিতভাবে তাদের পক্ষে চলে আসবে। স্যার হেনরী স্থির করলেন, তাঁরা যতো দুঃসাহসী হবেন, তাঁদের নীতি ততোটুকু নির্ভুল হবে। অযোধ্যার গোলন্দাজ সেনাদলের দুর্বলতা এবং দেশীয় গোলন্দাজ সেনাদের ভীরুতার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারেনি। শত্রুদের শক্তি সম্বন্ধে সঠিক খবর স্যার হেনরীকে জানানো হয়নি। সেজন্য যুদ্ধে ব্রিটিশপক্ষ চরমতম ক্ষতির সম্মুখীন হলো।
ব্রিটিশ সেনার পরাজয়ের সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শিশু এবং মহিলারা ধন-সম্পদ অরক্ষিত রেখে সমস্ত ঘাঁটি থেকে রেসিডেন্টের বাড়িতে পালিয়ে যেতে লাগলেন। সকলেই আপনাপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। সক্ষম পুরুষেরা অস্ত্র হাতে পরিখার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে লাগলেন। সে যাহোক, বিজয়ী বাহিনী কিন্তু শত্রুদের এ শঙ্কার কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি। তারা যদি শত্রুর পিছু পিছু ধাওয়া করতো তাহলে সম্ভবততা শত্রুর ছাউনি অধিকার করে নিতে পারতো। বিরতিটুকু ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য দৈবী সুযোগ। এ সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পথ খোলা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের মোকাবেলা করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো।