আটা পাঠিয়েছে তাতে ভেজাল রয়েছে। সেপাইরা জেদ করতে লাগলো, এ ভেজাল আটা নদীতে ফেলে দেয়া হোক। যদিও পরে আটা নদীর জলে ফেলে দেয়া হলো, তথাপিও সেপাইদের ক্ষোভ গেলো না। পরদিন বিদ্রোহ শুরু হলো। কর্ণেল বার্চ যিনি ৪১নং স্বদেশী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হলো। ৪১নং স্বদেশী বাহিনী এবং অনিয়মিত অযোধ্যা বাহিনী একই সঙ্গে বিদ্রোহ শুরু করলো। খ্রীস্টিয়ান পরিবার এবং বাঙলোতে আশ্রয় প্রাপ্ত সকল ইউরোপীয়কে নিয়ে পলায়ন করতে পরিকল্পনা করেছিলেন। কয়েকজন ছাড়া কেউই রেহাই পায়নি, সকলকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
ফৈজাবাদের কাহিনী সম্পূর্ণ আলাদা। ফেব্রুয়ারি মাসে শহরে এলেন এক রহস্যময় মানুষ, পরে অবশ্য জানা গিয়েছিলো তিনি হলেন ফৈজাবাদের মৌলবি। তিনি কে এবং কোন্ স্থান থেকে এসেছেন, সে সম্বন্ধে কিছু জানতো না কেউ। তিনি আহমদ আলী শাহ্ এবং সেকান্দার শাহ্ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কিছু সংখ্যক সশস্ত্র শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তাঁর শিষ্য ছড়িয়ে ছিলো। তিনি প্রকাশ্যে ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং গরম গরম বক্তৃতা দিতেন। পুলিশ জোর করে তাকে এবং তার শিষ্যবর্গকে নিরস্ত্র করলো এবং জনসাধারণের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া নিরাপদ মনে না করায় সামরিক তত্ত্বাবধানে তাঁকে রাখা হলো। বিদ্রোহের সূচনাকালে তিনি ছিলেন বন্দী।
ফৈজাবাদেও এলাহাবাদের মতো বিদ্রোহ শুরু হলো। তার ফলে বেনারসের সেপাইদের নিরস্ত্র করা হলো। বলা হয়ে থাকে, বেনারসের সেপাইদের নিরস্ত্র করে গোলন্দাজ বাহিনী এবং ইউরোপীয় পদাতিক বাহিনী তা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ফৈজাবাদে সেপাইরা রাজকোষ দখল করে নিলো এবং ইংরেজদের শান্তিতে চলে যেতে নির্দেশ দিলো। তারা ইংরেজদের জন্য নৌকা সংগ্রহ করলো, অর্থ প্রদান করলো; এমনকি অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিলো। অশ্বারোহী বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে ছেড়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলো না, কিন্তু পদাতিক বাহিনী তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। সে যাহোক বৈরামঘাটে আজমগড় থেকে আগত সেপাইরা দু’খানি নৌকার ওপর হামলা করলো। কর্ণেল গোল্ডনি এবং কমিশনারসহ অনেকেই নিহত হলেন।
স্থানীয় ভদ্রলোকদের মনোভাব এখনো বন্ধুত্বপূর্ণ। ফৈজাবাদ থেকে আগত অনেক মহিলা এবং শিশু শাহগঞ্জ দুর্গে আশ্রয় লাভ করেছিলেন। শাহগঞ্জ ছিলো রাজা মানসিং-এর সদর দফতর। রাজা মানসিং পুরোনো অভিজাত খান্দানের ছিলেন না। তাছাড়া জাতিতে তিনি রাজপুত ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। তিনি দুর্গে মহিলা এবং শিশুদেরকে আশ্রয় দিলেন, কিন্তু পুরুষদের ঢুকতে দিলেন না। তাহলে বিদ্রোহীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে বলে তিনি আশঙ্কা করতে লাগলেন। তাছাড়াও শাহগঞ্জে তিনি আশ্রয় প্রার্থীদের বেশিদিন রাখলেন না। তাঁদেরকে দানাপুরে পাঠিয়ে দিলেন নৌকাযোগে।
বাহরাইকের কমিশনার চার্লস উইংফিল্ড কিছু গোলমালের আভাস পেয়েই ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেলেন। ১৮৫৭ সালের ১লা মে তারিখে তিনি তাঁর সদর দফতরে ছিলেন না। সিকরোরা সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো ইউরোপীয় সৈন্য ছিলো না। এক রেজিমেন্টে অশ্বারোহী, এক রেজিমেন্ট পদাতিক এবং কিছু সংখ্যক গোলন্দাজ সৈন্য মিলে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করেছিলো। মহিলা এবং শিশুদের নিরাপদে লখনৌতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেজন্য অফিসারদের কোনো উদ্বেগ বা শঙ্কা ছিলো না। ইউরোপীয় সার্জেন্টদের সেপাইদের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দেয়া হলো। যদি কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখে তাহলে তাদের অফিসারদের জানাতে বলা হয়েছিলো। ৮ই জুনের মাঝরাতে এক সার্জেন্ট ভাবলেন, তিনি পদাতিক সেপাইদের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করেছেন। তৎক্ষণাই একটা ব্যাটারি আনা হলো এবং ব্যারাকের সামনে স্থাপন করতে নিয়ে যাওয়া হলো। আর কিছুই ঘটলো না। পরদিন সকালে সৈন্যেরা অভিযোগ করলো যে অফিসারেরা তাদের ঘুমের মধ্যে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা শুধু বন্ধু গোলন্দাজদের কৃপাতেই রক্ষা পেয়েছে। পদাতিক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর মধ্যে পুরোনো ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটলো এবং তারা মিলে দাবি করতে লাগলো যে এক্ষুণি তাদেরকে ক্যাপটেন বয়লিউ প্যারেডে আহ্বান করুন এবং তাদেরকে অস্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হোক। বয়লিউ আত্মসমর্পণ করলেন, কিন্তু উইংফিল্ড ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে কোনো কিছু জানতে না দিয়ে গোন্ডাতে অশ্বারোহণ করে স্থানান্তরে চলে গেলেন। গোলন্দাজ বিভাগের অধ্যক্ষ, লেফটেন্যান্ট বনহ্যাম ছাড়া আর সকলেই ছাউনি পরিত্যাগ করলেন। গোলন্দাজ বাহিনী তাকে অধিনায়কত্ব গ্রহণ করতে বললেন, তিনি রাজী হলেন। এ শর্তে যে তারা মার্চ করে লখনৌ যাত্রা করবে। প্রথমতঃ সেপাইরা তাঁর কথা মেনে চলতে রাজী হলেন, কিন্তু পরে অবস্থা বিভিন্ন রকম দাঁড়ালো। তারা বনহ্যামকে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। তাঁকে প্রধান রাজপথ দিয়ে না যেতে অনুরোধ করা হলো। তিনি নিরাপদে লখনৌতে এসে পৌঁছালেন।
উইংফিল্ড বেশিক্ষণ গোলাতে অবস্থান করেননি। তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা বলরামপুরের রাজার বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করলেন। দলের মধ্যে একজন ছিলেন ডঃ বাড্রাম, তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে চিঠিতে লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত সেপাইদের মনোভাব খুব ভালো ছিলো। আসবার পথে অনেকেই আমাদের সাথী হতে চেয়েছে, তাদের চোখের জল ঝরেছে। দেশীয় অফিসারেরা সালাম করেছে, কিন্তু কারো ইচ্ছা নয় যে আমরা অবস্থান করি। সকালবেলা হাবিলদার মেজর আমাদের কাছে এসে সিকরোরা থেকে প্রাপ্ত একখানা চিঠি দেখালেন। চিঠিখানার মর্ম হলো-‘অফিসারদেরকে বন্দী করো এবং রাজকোষ অধিকার করে। সুতরাং এ হলো আমাদের সর্বশেষ সুযোগ।’