সেপাইদের অসন্তোষ দেখে ইংরেজ অফিসারেরা বিস্মিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, তাঁদের বিস্মিত হওয়ার কথাই বটে। সেপাইরাও মানুষ, তাদেরও মন আছে। সে মনে আছে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা! সেপাইদের মনের খোঁজ যারা রাখে না তাদের বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে। কিন্তু মাথা খারাপ করেনি। সামরিক ঘাঁটির অধ্যক্ষ অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে বিক্ষোভ এবং অসন্তোষ দমন করলেন। বিদ্রোহীদের কঠোর দণ্ডদান করলেন। খবর কিন্তু চেপে রাখতে পারলেন না, দাবানলের মতো অন্য তিনটি কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইরা
অতি সহজে পিতৃপুরুষের ধর্মের প্রতি এ অপমান হজম করতে পারলো না। অন্য তিনটি প্রেসিডেন্সীর সেপাইদের মনে প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। অবশেষে ইংরেজরা তাদের ভুল বুঝতে পারলো। এ প্রথা রহিত করা হলো। সেপাইদের ধর্মীয় ব্যাপারে ইংরেজরা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না এ মর্মে গভর্ণরের নির্দেশ প্রচারিত হলো। তখন বেলুড়ের দুর্গে টিপু সুলতানের ছেলেরা নজরবন্দী অবস্থায় ইংরেজদের প্রদত্ত বৃত্তি ভোগ করে অবস্থান করছিলেন। ইংরেজদের অনেকেই বেলুড়ের সেপাইদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে রাজনৈতিক রঙ দেবার চেষ্টা করেছে। বিদ্রোহের সঙ্গে টিপু সুলতানের ছেলেদের কোনো যোগাযোগ ছিলো না। সেপাইদের সম্বন্ধে ইংরেজদের অজ্ঞতার কারণেই বেলুড় বিদ্রোহের সূত্রপাত। সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি সেপাইরা সন্দিহান হয়ে না উঠলে কোনো রাজনৈতিক প্ররোচনাই সেপাইদেরকে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করতে পারতো না।
বেলুড় বিদ্রোহের আঠারো বছরও অতীত হয়নি। ইংরেজদের প্রতি সেপাইদের আনুগত্য আবার এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন হলো। ভারতের পূর্বৰ্তম সীমান্তে আসাম। আসামের সঙ্গে ব্রহ্মদেশকে সংযুক্ত করা হয়েছে। দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছিলো। ১৮২৪ সালে শুরু হয় যুদ্ধ। সেপাইদের ব্রহ্মদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। আসামের ওপর দিয়ে ব্রহ্মদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ করতে তাদের আপত্তি ছিলো না। ভারতবর্ষীয়, সুপ্রাচীন হিন্দু প্রথা অনুসারে কালাপানি অতিক্রম করা হিন্দুদের পক্ষে মহাপাপ। তাই বাঙালি পল্টন আপত্তি তুললো। কিন্তু বাঙালি পল্টনকে যেতে হলো না। মাদ্রাজী সেপাইরা কোনো রকমের হাঙ্গামা হুজ্জত ছাড়াই কালাপানি পেরিয়ে যুদ্ধ করতে রেঙ্গুন যাত্রা করলো। বাঙালি পল্টনের ওপর নির্দেশ দেয়া হলো স্থলপথে মার্চ করে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে ব্রহ্মদেশের স্থল সীমান্তে গিয়ে জড়ো হতে। কিন্তু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সেপাইদের জন্য যানবাহন সংগ্রহ করতে পারলো না। ৪৭ নং রেজিমেন্টের সেপাইদের ব্যারাকপুর ছাউনি থেকে মার্চ করতে আদেশ দেয়া হলো। বলা হলো তাদেরকে আপন আপন মালপত্র বহন করার জন্য বলদ এবং গরুর গাড়ি যোগাড় করে নিতে। সেপাইরা হতাশ হয়ে পড়লো। সরকার যেখানে যথাসাধ্য চেষ্টা করে বিফল হয়েছে সেখানে তারা কেমন করে বলদ এবং গরুর গাড়ি যোগাড় করবে? সামান্য সেপাইদের শক্তি কতদূর? তাদের কাছে এ সরকারি নির্দেশ অন্যায্য মনে হলো। এ সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লো, একবার যদি চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছে তারা পছন্দ করুক আর না করুক, তাদেরকে শেষ পর্যন্ত যাত্রা করতেই হবে। তারা একজন অফিসারকে দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতির জন্য আবেদন করলো। কোনো রকম প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত তারা ছাউনি ত্যাগ করলো না। ফিরতি পথে রামুতে এ গুজব শুনবার পর সেপাইদের মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, জানবার উপায় নেই। যাহোক, সেপাইরা তাদের জাত, কুল, ধর্মনাশের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লো। এ সময়ে সর্বাধিনায়ক ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড প্যাজেট। তিনি ছিলেন কঠোর মানুষ। সেপাইদের মধ্যে শৃঙ্খলার সামান্য হেরফেরও তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। তা ছাড়া কোনো সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় দেয়া যায় না। যুদ্ধের সময়ে তা আরো কঠোরতার সঙ্গে দমন করা হয়। স্যার এডওয়ার্ড এ দেশীয় সেপাইদের কুসংস্কারের প্রতি ছিলেন খড়গহস্ত। অল্পসংখ্যক ইউরোপীয় সৈন্য নিয়ে তিনি ব্যারাকপুর যাত্রা করলেন। সেপাইদের তাদের অপরাধের জন্য তীব্র ভাষায় তিরস্কার করলেন। তাদের হয়তো মার্চ করতে অথবা অস্ত্র সংবরণ করতে আদেশ দিলেন। সেপাইদের কোনো অযৌক্তিক অনুরোধ এ ইংরেজ সন্তানটি কানে তুলতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু সৈন্যরা গালাগালি সহ্য করেও শৃঙ্খলার উর্ধ্বে ধর্মকে স্থান দিয়ে ছাউনির ভেতর রয়ে গেলো। তাদের পক্ষে যুক্তি হলো, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে এমন কোনো অভিযানে অংশগ্রহণ করতে তারা চুক্তিবদ্ধ নয়। তারা মনে করলো, সর্বাধিনায়কের আদেশ না মেনে তারা একটুকুও অন্যায় করছে না। তাই বলে কোনো সশস্ত্র বাধাও দেয়নি। আদেশ অমান্যকারী সেপাইদের শাস্তি দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর স্যার প্যাজেটের আদেশে এ হতভাগাদের নিষ্ঠুরভাবে গুলী করে হত্যা করা হলো। অনেকে আতঙ্কে পালিয়ে গেলো। এখানেই শেষ নয়। দলপতিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। ৭নং রেজিমেন্টের নাম সম্পূর্ণভাবে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো। এভাবে ব্রিটিশ শাসকেরা ব্যারাকপুরে এদেশীয় সেপাইদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার আরেকটা নজীর স্থাপন করলো।