ইংরেজরা কিন্তু সেপাইদেরকে আহত করতে চায়নি। তলোয়ার এবং কূটকৌশলের বলেই ইংরেজ কোম্পানী হিন্দুস্থানের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে পাকাঁপোক্ত হয়ে বসেছে। কিন্তু তারা এটাও জানতো যে শুধুমাত্র তলোয়ারের ওপর নির্ভর করে চিরকাল হিন্দুস্থান শাসন করা যাবে না। আবার তাদের বিশ্বাস, স্থির বিশ্বাস, জাত হিসেবে তারা হিন্দুস্থানীদের তুলনায় শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-দর্শন এবং রাজ্যশাসন বিষয়ে অনেক উন্নততরো জাতি। প্রাচ্যের অশিক্ষিত সভ্যতা সংস্কৃতিহীন মানুষদের প্রতীচীর সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলার অল্প বিস্তর ইচ্ছাও তাদের মধ্যে ছিলো। ইংরেজরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে এদেশের জনসাধারণকে উন্নত করতে আগ্রহী ছিলো না এ কথাও সর্বাংশে সত্য নয়।
শাসক এবং শাসিতের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুতেই এক হতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যের কারণে ইংরেজের ভালো কাজগুলোও এদেশবাসীর দৃষ্টিতে খারাপ ঠেকলো। ইংরেজকৃত সামাজিক সংস্কারগুলোকে এদেশের হিন্দু-মুসলমান তাদের খৃস্টানে পরিণত করার দুরভিসন্ধি মনে করলো।
আগের স্বৈরাচারী শাসনের স্থলে ইংরেজ এক ধরনের আইনের শাসন কায়েম করেছিলো। কিন্তু অবস্থার বৈগুণ্যে ইংরেজের সমস্ত ভালো কাজই বিষময় ফল প্রসব করলো।
ইংরেজরা ভুল করেছিলো। একটি ভিন্ন দেশের প্রায় অচেনা অধিবাসীদের সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি তাদের আত্যন্তিক আগ্রহ পরবর্তীকালে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সংস্কার করতে গিয়ে কোনটা প্রয়োজনীয়, কোনটা অপ্রয়োজনীয় অতোটুকু বাছবিচার করার সময় ইংরেজদের ছিলো না। তাতে করে হিন্দুস্থানের জনসাধারণের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের অনলই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
১৮০৬ সালে স্যার জর্জ বার্লো নামে এক নিরীহ ভদ্রলোক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতের গভর্ণর জেনারেল। সে সময়েই সেপাইদের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মীয় বিক্ষোভের সূচনা। তখন তিনটা প্রেসিডেন্সীর প্রত্যেকটিই সামরিক দিক দিয়ে স্বাধীন ছিলো। মাদ্রাজের ইংরেজ অফিসারদের মাথায় একটা নতুন ভাবনা এলো-সেপাইদের শুধু কাজে চটপটে হলে তো চলবে না, দেখতেও তাদের চটপটে হতে হবে। বাস হুকুম জারি হয়ে হয়ে গেলো। হিন্দু সেপাইরা কপালের গোত্রচিহ্ন মুছে ফেলো, মুসলমান সেপাইরা লম্বা দাড়ি কেটে ফেলো। আর গোঁফ রাখতে চাও তো তাহলে কেটেছেটে ছুঁচোলো করে রাখো। ইংরেজ কর্তারা দাড়ি, গোঁফ, তিলক সংস্কারের নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হলেন না। বলা হলো, কাপড়ের পাগড়ী বদলে পরতে হবে চর্মনির্মিত মস্তকাবরণ। তাতে থাকবে একটি থোবা। তবেই তো দেখাবে সেপাইর মতো।
আজকের দিনের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখলে এসব সংস্কারকে কিছুই মনে হবে না। কিন্তু আজ থেকে একশো পঞ্চাশ বছর আগে এদেশের হিন্দু মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। সেপাইদের মনে ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ ফেনিয়ে উঠলো। বিদেশী ইংরেজ তাদের চালচলন রীতিনীতি সবকিছু এদেশের হিন্দু-মুসলমানের কাছে ছিলো দুর্বোধ্য। মুসলমানদের দাড়ি রাখা ধর্মীয় কর্তব্য। হিন্দুদের কাছে কপালে গোত্রচিহ্ন ধারণ করাও কম পবিত্র নয়। তদুপরি কাপড়ের পাগড়ীর বদলে চর্মনির্মিত মস্তকাবরণ পরিধান করা। সে চামড়া গরুর কি শূয়রের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তার চাইতে হীন কাজ আর পৃথিবীতে নেই। ও যদি মাথায় একবার পরে, তাহলে ধর্ম হারাবে, জাত হারাবে, পরকাল হারাবে। আত্মীয়স্বজনেরা কেউ সমাজে গ্রহণ করবে না। একি আপদ! এর চেয়ে বরং মরণ অধিক শ্রেয়।
ইংরেজেরা শাসক গোষ্ঠি। এসব ভাবনা তারা ভাববে কেননা । নির্দেশ মাত্রই নির্দেশ। দাড়ি রাখলে ভালো দেখায় না, দাড়ি কেটে ফেলো, গোত্র-তিলক মুছে ফেলো। এমন ভালো কাজটা করতে যে কেননা আপত্তি করবে, ইংরেজ অফিসারেরা এ কথা চিন্তা করতে পারে না।
এদিকে সেপাইরা মনে করলো শাসকদের মনে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ দূরভিসন্ধি আছে। আজ বলছে দাড়ি কেটে ফেলো, পাগড়ীর বদলে চামড়ার টুপী পরো। কাল বলবে খ্রীস্টনাম জপ করো। পরশুদিন বলবে তোমার বাপ-দাদা সকলে পাপী… তুমি প্রভু যীশুর মতে দীক্ষা নিয়ে পরিত্রাণ প্রার্থনা করো। যুদ্ধ করা সেপাইদের পেশা। তারা তেজারতি করে না, চাষবাস করে না, আর কোনো হুনুর হেকমত জানে না। যুদ্ধই তাদের চাষবাস, যুদ্ধই তাদের তেজারতি। যুদ্ধ করা সম্মানজনক পেশা… তাতে আয়ও হয় মন্দ না। মনিবের হুকুম মানতে তারা প্রস্তুত। এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় বদলী করুক, তারা যেতে রাজী আছে। কিন্তু উপর অলার আদেশে পিতৃপুরুষের ধর্মের অবমাননা তারা কখনো করতে পারবে না। এমন কি প্রাণ গেলেও না। এদেশীয় কানুন মতে তারা নিমক হালাল হলেই হলো! তারা কখনও নিমক হারামি করেনি। তারপরেও তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মের ওপর হামলা করার অর্থ তাদের অজু, নামাজ, সন্ধ্যা আহ্নিককে অবজ্ঞা করতে পারে। এনিয়ে তারা ঠাট্টা–বিদ্রূপও করতে পারে। কিন্তু এগুলো তাদের কাছে মুক্তির উপায়। ধর্ম বিশ্বাসে অটল থাকলেই সহযোদ্ধার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে। একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু একজন মুসলমানকে শ্রদ্ধা করে। আপন ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাহীন লোককে অন্য ধর্মের মানুষও ঘৃণার চোখে দেখে। চামড়ার মস্তকাবরণ পরলে তাদের জাত যাবে, ধর্ম নষ্ট হবে, আত্মীয়স্বজনের চোখে পতিত হবে, চৌদ্দ পুরুষের মুক্তির উপায় থাকবে না। সুতরাং তারা তা পারবে না। কঠোর পণ! কঠিন প্রতিজ্ঞা। দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদেরকে চামড়ার মস্তকাবরণ পরতে বাধ্য করতে পারবে না। বেলুড়ে চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন নিয়ে সহস্র শিখায় মহাবিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিলো, পঞ্চাশ বছর আগে চামড়ার মস্তকাবরণ প্রবর্তনের প্রতিবাদে তার প্রথম ফুলকি জাগে।