তাঁতিয়া টোপী ছিলেন নানা সাহেবের সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। সামরিক অভিজ্ঞতাও তার ছিলো না। কিন্তু তিনি গেরিলা যুদ্ধের নব নব কলা-কৌশল উদ্ভাবন করে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে যেভাবে বারে বারে পর্যদস্ত করেছিলেন তার সবটুকু গৌরব এখনো তাকে দেয়া হয়নি।
একই কথা ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কেও বলবো। রাজকুলে এই মহীয়সী নারীর জন্ম হয়নি; যদিও রাজার সঙ্গে তার পরিণয় ঘটেছিলো। যুদ্ধের সময় এই অসাধারণ তেজস্বী মহিলা যে সাহস কৌশল এবং দেশপ্রেম প্রদর্শন করেছিলেন তা ইতিহাসের এক গর্বের বস্তু।
মাওলানা আহমদউল্লাহও অভিজাতদের কেউ ছিলেন না। তিনি নিতান্তই সাধারণ মানুষের সন্তান এবং নিজেও ছিলেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু যুদ্ধের সময় সেপাইদের যেভাবে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও একের পরে এক যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছেন। সেই কাহিনীও কোনোদিন ভুলে যাবার নয়।
কুমার রাম সিং ছিলেন একজন সামন্ত ভূস্বামী। সিপাহী যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিলো আশি বছর। এ বয়সেও বুড়ো সিংহ সিংহের বিক্রম নিয়ে লড়াই করে গেছেন। নৌকাযোগে গঙ্গা পার হবার সময় বৃটিশ কামানের গোলায় তার ডান হাত অকেজো হয়ে গেলে বাঁ হাতে তলোয়ার ধরে এক কোপে ডান হাত কেটে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, মা গঙ্গা তোমার বুকে আমার দক্ষিণ হস্ত অঞ্জলি দিলাম।
বাবর, আকবর, আওরঙ্গজেব যে বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, প্রায় পাঁচশ বছর স্থায়ী সেই তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারীরা কোনো সাহস, কোনো বীরত্ব, কোনো রকম রণচাতুর্য প্রদর্শন করতে পারেনি। একমাত্র শাহজাদা ফিরোজ শাহই ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বাবর-আকবরের বংশের সব মোগল যে কাপুরুষ নয়, একজন তার ব্যতিক্রম আছে এটা শাহজাদা ফিরোজ শাহ্ প্রমাণ করে মোগল বংশকে কিছুটা কলংকের হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন।
সিপাহী যুদ্ধের ঘটনাটি ব্যাপ্তিতে এবং গভীরতায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতুলনীয়। এই যুদ্ধের গুরুত্ব মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের মতোই ভয়াবহ এবং তাৎপর্য সম্পন্ন। এই যুদ্ধের ফলে ভারতের সামন্ত প্রভুরা ঝাড়ে বংশে ধ্বংস হয়েছে এবং বৃটিশ শাসন সম্পূর্ণরূপে নিষ্কন্টক হয়েছে। বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা সিপাহী যুদ্ধ ঘটে যাওয়ার অনেকদিন পর পর্যন্ত এ যুদ্ধকে তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে যখন জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের উন্মেষ ঘটতে আরম্ভ করে ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা সিপাহী যুদ্ধের মধ্যে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগামের উৎস অনুসন্ধান করতে থাকেন। অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন এমন ঐতিহাসিকও যথেষ্ট রয়েছেন।
আমি আজিমুল্লাহ, তাঁতিয়া টোপী, ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈ, মাওলানা আহমদউল্লাহ এ সমস্ত সাধারণ মানুষের অসাধারণ পুত্র কন্যাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার উদ্দেশ্যে এ নতুন ভূমিকা রচনা করলাম। সামন্তবাদের জগদ্দল ঠেলে এ অসাধারণ মানুষ মানুষীরা যদি যথার্থ ভূমিকায় অভিনয় করতে পারতেন তাহলে এই যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখিত হতো।
আমার বন্ধু উবিনীগ প্রধান কবি ফরহাদ মজহার আমার গ্রন্থের এ সংস্করণটি প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তারিফ করে তাঁকে বেকায়দায় ফেলা উচিত হবে না।
বিনীত
আহমদ ছফা
১২/১ ময়মনসিংহ রোড
ঢাকা ১০০০
১-২-৯৬
সূচীপত্র
এক. বিদ্রোহের কারণ
দুই. ঘটনা পরম্পরা
তিন. এই সে দিল্লী–এই সে নগরী
চার. কানপুর ও ধাবমান দাবানল
পাঁচ. অযোধ্যা : গজল কাননের অগ্নি-গোধুলি
ছয়. বিহার ও ওহাবী-সিপাহী যুগল সম্মিলন
সাত. ‘মেরে ঝাঁসী নেহী দেওঙ্গী’
আট. অবনমিত রোহিলা ঝাণ্ডা
১. বিদ্রোহের কারণ-বীজ
১৮৫৭ সালে সমগ্র হিন্দুস্থানের সেপাইরা বিদেশী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মেতে উঠেছিল। এর কারণ কি?
এই সেপাইদের তপ্ত রক্ত বিসর্জনেই তো কলকাতা থেকে পেশোয়র পর্যন্ত কোম্পানীর রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছে। এই সেপাইরাই তো ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে, আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বিরাট ভূখণ্ডের অধীশ্বর করেছে বেনিয়া ব্রিটিশ কোম্পানীকে। হঠাৎ করে তারা এমন করে দাবানলের মত ক্ষেপে উঠলো কেনো? কোন সে কারণ, যা ইংরেজভক্ত সেপাইদেরকে এমন ব্যাপক প্রচণ্ড বিদ্রোহে উদ্দীপিত করেছিলো।
একবাক্যে সকলেই বলবেন, চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তনই বিদ্রোহের সাক্ষাৎ এবং প্রত্যক্ষ কারণ। তাতো বটেই। কিন্তু এতো বড় একটি বিদ্রোহ যা দমন করতে ইংরেজের মতো একটি বিরাট শক্তিকেও এতো হিমশিম খেতে হয়েছে শুধুমাত্র টোটার মতো সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অমন বিরাট একটি বিদ্রোহ তো সংঘটিত হওয়ার কথা নয়।
এই বিদ্রোহের পেছনে সংগুপ্ত ছিলো আরো অনেক কারণ। সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে গোপনে গোপনে শক্তি সঞ্চয় করে আসছিলো। অবশেষে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, সেপাইরা কোম্পানী রাজের উপর বিশ্বাসের রেশটুকুও হারাতে বাধ্য হলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করতে লাগলো। এতোদিন ধরে বৃথাই আমরা রক্ত ঢেলেছি, বৃথাই ইংরেজ রাজ্য বিস্তারের জন্য মরণপণ সংগ্রাম করেছি। বিনিময়ে আমাদের কি দিয়েছে ইংরেজ? তারা আমাদের দেশের দেশীয় রাজ্যগুলো একের পর এক গ্রাস করে চলেছে। রাজন্যবর্গের সম্মান ধরে টান দিয়েছে। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার সীমা নেই। চৌকিদারির ট্যাক্স চার পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করেছে। আগে বাদশাহী আমলে খাজনার দাবি যেখানে ছিল দু’শ টাকা ইংরেজ আমলে তা তিনশ করা হয়েছে। চার’শ টাকা খাজনার স্থলে পাঁচ’শ ধার্য করা হয়েছে। তারপরেও তো কোম্পানী বাহাদুরের খাই মেটে না। তারা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কাজের তালাশে গমনকারী লোকদের ওপর মাথাপিছু ছ’পয়সা করে কর ধার্য করলো। জেলায় সীমানা অতিক্রম করার সময় প্রতিটি গরুর গাড়ি পিছু চার থেকে ছ’আনা কর দিতে হতো ব্যবসায়ীদের। পুরনো সম্ভান্তশ্রেণীর লোকদের আয় একেবারে কমে এলো। এতেই শেষ নয়, কোম্পানীর লোকেরা তাদেরকে দিয়ে চর্বি মেশানো টোটা ব্যবহার করিয়ে পিতৃপুরুষের ধর্ম নাশ করতে চায়। পেটের দায়ে কোম্পানী বাহাদুরের চাকুরি করে বটে কিন্তু ধর্ম তো তাদের প্রাণের চেয়ে কম প্রিয় নয়। বিদেশী শাসকগোষ্ঠির কোন নির্দেশেই তারা ধর্মীয় অনুশাসনের সামান্য খেলাপ করেও পরকাল ঝরঝরে করতে প্রস্তুত নয়। এমন কি প্রাণ গেলেও না। এ ব্যাপারে দিল্লীর সম্রাট লখনৌর ওয়ালী এবং পেশোবার উওরাধিকারীরা তাদের সঙ্গে একমত।