সহৃদয় রম্য-সাহিত্যিক জনাব লুৎফর রহমান সরকার সাহেব এই গ্রন্থটি ছাপা হওয়ার সময়ে আমাকে এক হাজার টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করেছেন। কল্যাণীয়া লুতফা হাসিন রোজী কীটদষ্ট প্রথম পৃষ্ঠা এবং শেষের ক’টি পৃষ্ঠা পুনরুদ্ধার করার কাজে সাহায্য করেছে। কল্যাণীয় মহিউদ্দিন প্রথম একশো পৃষ্ঠার নির্ঘণ্ট তৈরি করে দিয়েছে। শ্রদ্ধেয় ডঃ নাজমুল করিম মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি অধ্যায় দীর্ঘ রাত্রি ধরে আমাকে দিয়ে পাঠ করিয়ে শুনেছেন এবং এতে মনে করেছি দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম কিছুটা যেনো হাল্কা হয়েছে। কবি আসাদ চৌধুরী অনুগ্রহ করে মলাটের পেছনের পৃষ্ঠার গ্রন্থ পরিচিতিটি লিখে দিয়েছেন। ধীমান ইতিহাসবিদ ডঃ মমতাজুর রহমান তরফদার পরিচায়িকা লিখেছেন এই বইয়ের। এটা তার স্বভাবসঞ্জাত উদারতা, গ্রন্থের কোনো গুণ নয়। চেনা জানা কতো মানুষ যে সাহায্য করেছেন, সকলের নাম উল্লেখ করার ক্ষমতা আমার নেই। সকলের কথা বলে শেষ করতে পারবো না।
আহমদ ছফা
১০৭, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২২ শে অক্টোবর, ১৯৭৯
ঢাকা।
তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা
এই গ্রন্থটা লিখেছিলাম দেশ স্বাধীন হবার আগে। ছাপা হয়েছিলো ষোল বছর পর। এ-সময়ের মধ্যে বইটির দু’টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। কোলকাতায়ও বইটির একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন করে বইটি ছাপার প্রাক্কালে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা শুরু করেছিলাম একটি বাক্য দিয়ে আমার যৌবনধর্মের অপরাধের প্রমাণ এই গ্রন্থ। লিখেছিলাম বিএ পাশ করার আগে। মাঝে মাঝে বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আকাঙ্ক্ষাও জেগেছিলো। কারণটা স্পষ্ট করে বলি, বর্তমানে অতো অমানুষিক পরিশ্রম করে এ রকম একটি রচনা লেখার ক্ষমতা আমার হবে না। তা ছাড়া যদি লিখতেই হতো আমি সিপাহী যুদ্ধের আনুপূর্বিক ঘটনা বর্ণনা করার বদলে সিপাহী যুদ্ধের কতিপয় কুশীলবকে নিয়ে একটি ভিন্ন রকমের গ্রন্থ রচনা করতে চেষ্টা করতাম।
দিল্লীর সম্রাট বাহাদুর শাহ্ থেকে শুরু করে যে-সমস্ত রাজা মহারাজা তাঁদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেপাইদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে নতুন কথা বলার অবকাশ নেই। তাঁরা পরাজিত হবার জন্যই লড়াই করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানে দীক্ষিত, আধুনিক মননে সমৃদ্ধ, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বৃটিশ বাহিনীকে মুখোমুখী যুদ্ধে পরাজিত করার মানসিক শক্তি এবং সামরিক পারঙ্গমতা ভারতীয় সামন্ত সমাজের প্রতিভূ রাজা মহারাজ- নওয়াব-দিল্লীর সম্রাট কারো ছিলো না।
ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করলে সিপাহী যুদ্ধের ওপর তথ্যের পাহাড় গড়া যায়। অনেক অকথিত কাহিনীও প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু সেই সত্যটির ব্যত্যয় কখনো ঘটবে না। সামন্ত প্রভুরা পরাজিত হবার জন্য যুদ্ধের দায়দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। সিপাহী যুদ্ধের নায়কদের একের পর এক পরাজয়ের করুণ স্মৃতি মনকে বেদনা ভারাক্রান্ত করে এ কথা সত্য বটে, কিন্তু এ সামন্তদের থেকে শ্রদ্ধা করার মতো একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না একজন ব্যতিক্রম ছাড়া।
আসলে ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ইত্যাদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে দখল করে তাদের সাম্রাজ্যের অংশ করে নিয়েছিলো, বৃটিশের ভারত অধিকার তার একটা পর্যায়কে সূচিত করে মাত্র। ভারতবর্ষ যদি ইংরেজরা দখল না করতো তাহলে ফরাসিরা ভারতবর্ষে অধিকার বিস্তার করতো।
ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে যাঁরা বৃটিশের সৈন্যকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন প্রায় সকলেরই মর্মান্তিক পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছে। একমাত্র সে সকল রাজন্যবর্গই টিকে থাকতে পেরেছেন যাঁরা বৃটিশের দাসত্ব কবুল করে নিয়েছিলেন। মহীশূরের শার্দুল টিপু সুলতানই ছিলেন একমাত্র সম্মানজনক ব্যতিক্রম। তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজের সাফল্যজনকভাবে প্রতিরোধ করে আসছিলেন, তার প্রধান কারণ টিপু সুলতান আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তিনি আধুনিক যুগের মর্মবাণী অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং রাষ্ট্র নায়কের আধুনিক ভূমিকা কি হওয়া উচিত মোটামুটি সে সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট ধারণা তার ছিলো। তিনি নতুন শাসনপদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন, অর্থনীতির নতুন বিলিবন্টন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, সেনাবাহিনীকে ইউরোপীয় ধাঁচে ঢালাই ও সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। এ সকল কারণেই টিপু সুলতান দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইংরেজ শক্তিকে সাফল্যজনকভাবে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন। টিপু সুলতানকে পরাজিত করে মহীশূর দখল করার জন্য বৃটিশের মতো বিশ্বের একটি প্রথম শ্রেণীর শক্তিকে তাদের মিত্র রাজন্যবর্গের সহায়তা সত্ত্বেও যথেষ্ট রকম বেগ পেতে হয়েছে। ছল-বল কল-কৌশল সব কিছু একযোগে প্রয়োগ করে টিপু সুলতানকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিলো। টিপু সুলতানের পরাজয় মহৎ পরাজয়। তাঁর আত্মদানের ট্র্যাজিক মহত্ব কোনোদিন ম্লান হবার নয়।
২.
সিপাহী যুদ্ধের কতিপয় কুশীলবের প্রতি আমার মনে এমন এক ধরনের শ্রদ্ধা ঘনীভূত হয়েছে। যদি সময় এবং সুযোগ থাকতত এই মহান চরিত্রসমূহের গুণকীর্তন করে আমি আরেকটা নতুন বই লিখতাম এবং বর্তমান গ্রন্থটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতাম। সিপাহী বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনাকার আজিমুল্লাহর জীবনের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তুলে ধরতাম। এ অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিটির জন্ম অভিজাতকুলে নয়। পাঁচক হিসাবেই তিনি জীবন শুরু করেছিলেন। তারপর নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখে সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তিনি নানা সাহেবের উপদেষ্টার আসন অলংকৃত করেছিলেন এবং নানা সাহেবই তাঁকে তাঁর পক্ষে ওকালতি করার জন্য বিলাতে পাঠিয়েছিলেন। বিলাতের অভিজাত সমাজ আজিমুল্লাহকে গ্রহণ করেছিলো এবং মহিলারা প্রিন্স আজিমুল্লাহর প্রতি আসক্তও বোধ করতেন। সমস্ত আকর্ষণ, সমস্ত যোগ্যতা এবং প্রতিভা সত্ত্বেও আজিমুল্লাহ বৃটিশ প্রভুদের মনে তার মনিবের প্রতি অনুকম্পা সৃষ্টি করতে পারেননি। তাই বলে আজিমুল্লাহ ব্যর্থতাকেও মেনে নেননি। তিনি দেশে ফেরার পথে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেটা হলো এই বৃটিশরাও পরাজিত হয় এবং তাদের পরাজিত করা সম্ভবও বটে। বৃটিশকে পরাজিত করা যায় এ মন্ত্র নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সিপাহী যুদ্ধের বীজটি আজিমুল্লাহই বপন করেছেন। সে মহীরুহকে পরিণত করার পেছনে আজিমুল্লাহ যে ভূমিকা পালন করেন, এক কথায় সেটাকে অনন্য বললে যথেষ্ট বলা হবে না। অথচ আজিমুল্লাহর জীবনের পুরো কাহিনী আমরা কেউ জানিনে।