গ্রন্থের ভালমন্দের বিশদ আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার উদ্দেশ্য নয়। সে ভার সাধারণ পাঠক ও বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দিয়ে শুধু এই কথা বলতে চাই যে, এ গ্রন্থ আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজনা এবং আহমদ ছফার নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
মমতাজুর রহমান তরফদার
অধ্যাপক, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২২শে অক্টোবর ১৯৭৯
ঢাকা
স্বীকারোক্তি
আমার যৌবনধর্মের অপরাধের প্রমাণ এই গ্রন্থ। বিএ পরীক্ষা দেয়ার পর পরই এ গ্রন্থ লিখতে প্রবৃত্ত হই এবং শেষ করতে একটানা দু’বছর লেগে যায়। আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক শ্রী সত্যেন সেনের মহাবিদ্রোহের কাহিনী পড়ার পর এই বিষয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার আকাক্ষা মনে প্রথম জাগ্রত হয়। তার আগে মরহুম আরিফ চৌধুরী সাহেব বার বার এ বিষয়ে আমাকে কিছু লিখতে উপদেশ দেন। সে যাক, সত্যেন বাবুর অনুপ্রেরণায় আমার আকাঙ্ক্ষাটিকে কাজে রূপ দেয়ার পাকা সংকল্প গ্রহণ করি। প্রকাশ ভবনের স্বত্বাধিকারী জনাব আবদুল হক। লিখিতব্য গ্রন্থটি প্রকাশ করবেন আশ্বাস দেন এবং যে পরিমাণ অর্থ না পেলে দু’বেলা অন্নসংস্থান করে দীর্ঘ একটি গ্রন্থ লেখার কাজে দীর্ঘকাল একটানা লেগে থাকা সম্ভব নয়, তার একটা অংশ সময়ে সময়ে তিনি আমাকে সরবরাহ করেছেন। সেই সময়ে এই গ্রন্থের নামকরণ করেছিলাম ‘মহাজাগরণ’। মলাট ইত্যাদিও আঁকাজোকা হয়ে গিয়েছিলো। তারপরে কি কারণে জানি না হক সাহেব পাণ্ডুলিপি প্রেসে দিতে দেরী করলেন।
তখন অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি, প্রবন্ধ লেখক হওয়া এবং গরম বক্তৃতা দেয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলে যে লিখিত গ্রন্থটির প্রতি আমি সব রকমের অনুরাগ হারিয়ে ফেলি। এরই মধ্যে প্রায় দেড় বছর সময় চলে যায়। মাঝখানে একবার হক সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন যে তাড়াতাড়ি পাণ্ডুলিপিটি প্রেসে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। আমি তখন বেঁকে বসলাম। তাকে বললাম, ইতিহাস বিষয়ে আমার মতো অশিক্ষিত একজন লোকের লেখা অতোবড়ো একটি বই দেখলে আমার সাহিত্যিক বন্ধুরা হয়ত আমাকে ঠিশারা করবেন। আরো একটা ভয় আমার ছিলো। এ রকম জমকালো বিষয়ে গম্ভীর একখানি কেতাবের লেখক জানলে লোকে আমার লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, অন্যান্য রচনা পড়বে না। আমাদের দেশের পণ্ডিতদের লেখার প্রতি সাধারণ মার্জিত রুচির পাঠকদের একটা ভীতি এবং একটা অনীহার কথা আমি জানতাম। পাছে এ বইয়ের লেখক জেনে আমাকে পণ্ডিত মনে করে লোকে, সে আকাক্ষা করে প্রস্তাব করেছিলাম, হক সাহেব তাঁর নিজের নামে অথবা তাঁর স্ত্রীর নামে নিদেনপক্ষে তাঁর পরলোকগত পিতৃদেব কিংবা শ্বশুর সাহেবের নামে এ গ্রন্থ যদি প্রকাশ করেন আমার। কোনো আপত্তি থাকবে না, বরং সানন্দে স্বীকৃতি জানাবো। সেটিও ঘটেনি।
তারপরে প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে দুটি বছরের কঠোর বিরতিহীন পরিশ্রমে আমার কলম থেকে একটি ইতিহাসগ্রন্থ জন্ম নিয়েছিলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার সঙ্গে হক সাহেবের দেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সময় তিনিও আমাকে কিছু বলেননি। এরই মধ্যে একদিন, আজ থেকে প্রায় ছ’মাস আগে হক সাহেব কথায় কথায় আমাকে জানালেন, আমার ইতিহাস বইটি ছাপতে তার অনেক টাকা খরচ হবে। উপস্থিত মুহূর্তে অতো টাকা তাঁর নেই। আমি যদি অন্য কোনো প্রকাশক কিংবা বাংলা একাডেমী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বইটি ছেপে বের করতে পারি, তাহলে তিনি পাণ্ডুলিপিটি ফেরত দিতে রাজী আছেন। জন্মান্তরের স্মৃতির মতো আমার মনে ভেসে উঠলো এক সময়ে দৈনিক আট নয় ঘণ্টা খেটে দু’বছরে একখানা ইতিহাস লিখেছিলাম। অতীতের প্রতি একটা আকর্ষণ তো সকলেরই থাকে।
মুখ্যতঃ সে কারণে আমি পাণ্ডুলিপিটি কৌতূহলবশত দেখতে চাইলাম। তিনি দিন দশেক বাদে আমাকে পাণ্ডুলিপিটি প্রত্যর্পণ করলেন। দেখি জায়গায় জায়গায় উই পোকা পাণ্ডুলিপিটি কেটে ফেলেছে। প্রথম দিকের পৃষ্ঠাটি এবং শেষদিকের অনেকগুলো পাতা এই পাণ্ডুলিপিভুক কীটদের উদরে চলে গেছে। ভারী ব্যথা পেলাম।
এখানে সেখানে পড়ে দেখি যে বেশ ইতিহাস ইতিহাস একটা গন্ধ বইটার আছে। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে দেখাই। তারাও আমার সঙ্গে একমত হলেন। কেউ কেউ বললেন যে আমাদের এই বাংলাদেশে সিপাহী যুদ্ধের ওপর বাংলা ভাষায় লেখা একখানিও বই নেই। ছাপলে পণ্ডিতদের না হোক সাধারণ আগ্রহী পাঠকদের চাহিদা পূরণ করবে। এতোসব শুনে বাংলা একাডেমীর শরণাপন্ন হলাম। একাডেমী কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তারা আমার বই গ্রহণ করলেও কবে ছাপা হবে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিতে অপারগ। দশ বছরও লাগতে পারে আবার কমও লাগতে পারে কিংবা বেশিও লাগতে পারে। নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। পাণ্ডুলিপিটির যে মুমূর্ষ অবস্থা, ছ’মাসের পরমায়ু সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিলো। কি আর করবো। ভারী বুক নিয়ে ফিরে এলাম।
এর অব্যবহিত পরে বাড়িতে ডাকাত পড়ার মতো কিছু টাকার প্রয়োজন আমাকে প্রায় ক্ষিপ্ত করে তোলে। উপায়ান্তর না পেয়ে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আমার বন্ধু বুক-সোসাইটির স্বত্বাধিকারী মোস্তফা কামালের কাছে গিয়ে মৃত্যু পরোয়ানার মতো হাজির হই এবং সরাসরি দাবি করে বসি যে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে এবং পাণ্ডুলিপিটি অবিলম্বে ছেপে বের করতে হবে। তাঁর সম্পর্কে অধিক বলবো না। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি এ কারণে যে এরকম একজন বন্ধু আমার আছেন। তারপরে আর কোনো কথা নয়, দু’মাসের মধ্যে দশ বছর আগের লেখা পাণ্ডুলিপি কীট সহবাস পরিত্যাগ করে নতুন মোড়কে দিনের আলোর মুখ দেখলো। এরকম অবিশ্বাস্য কাণ্ড এই যুগে ঘটতে দেখলে কার না আনন্দ হয়!