সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় উপযুক্ত অফিসারদের হারালো। রাজনৈতিক এবং শাসনকার্যে অধিক সুবিধা দেয়া হলে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা সেদিকে ঝুঁকে পড়লেন। কেউ সেনাবিভাগে বড় একটা আসতে চাইতেন না। রেজিমেন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সমগ্র সেনাবাহিনীতে কখনও প্রতিভার অভাব হয়নি। অনেকেই ছিলেন, যারা ১৯৫৬-৫৭ সালের সঙ্কটে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণিত করেছিলেন এবং কেউ কেউ ফিল্ড মার্শাল হওয়ার সম্মান পর্যন্ত লাভ করেছেন। নতুন শাসনব্যবস্থা অনুসারে তরুণ অফিসারদের উপর রেজিমেন্টগুলোর দায়িত্ব দেয়া হলো, যাদের অনেকেই ছিলেন সেপাইদের কাছে আগন্তুক। সেজন্য সঙ্কটের সময়ে সেপাইদের মতামত ফেরানোর মতো ওজন তাঁদের ছিলো না। ব্রেসিয়ারের মতো অফিসার যখন এলাহাবাদের শিখ সেপাইদের বিদ্রোহ করা থেকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন, এটা বিশ্বাস করা যায় যে, অনুরূপ দক্ষতা এবং প্রাণশক্তিসম্পন্ন অফিসার অন্যান্য স্থানে থাকলেও তারা বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন। ভালো ভালো বেসামরিক অফিসারদের নতুন অধিকৃত পাঞ্জাবে বদলী করা হয়। শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক ভালো সিভিলিয়ান অযোধ্যা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কর্মরত ছিলেন।
শান্তির সময়ে ছাড়া দেশীয় অফিসারদের খুব বেশি কিছু করার ছিলো না। অনেকেই নিমকহারামী করেননি। কিন্তু বেশি বয়সে প্রমোশনের জন্য, তাদের যে পরিমাণ শক্তি, সাহস এবং উদ্দীপনার প্রয়োজন, তা আর তাদের শরীরে ছিলো না। ৪৫ বছর একটানা চাকুরী করার পর ৬৫ বছর বয়সে সীতারাম সুবাদার পদে উন্নীত হন। দেশীয় সেপাইরা এর চেয়ে কোনো উচ্চতরো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতো না। মিথ্যা অর্থনীতির অজুহাত দেখিয়ে ইউরোপীয় এবং দেশীয় সেপাইদের যে বয়সে অবসর গ্রহণ করা উচিত, সে বয়সে অবসর নিতে দেয়া হতো না। তার ফলে, ইউরোপীয়ান অফিসারেরা তাদের অধীনস্থ ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইতো না এবং ভারতীয় সেপাইরা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়তে এবং মানসিক ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলতো। সে কারণে অনেক রেজিমেন্টের শৃঙ্খলা ভয়ানকভাবে আহত হতো। অবশেষে পরিস্থিতি এমন জটিল আকার ধারণ করলো যে কালা আদমীরা প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আসল জবাব না দিয়ে, বানিয়ে বানিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতো। অফিসারেরা তাঁদের অধীনস্থ সেপাইদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞই রয়ে গেলেন। কারণ জমাদার এবং সুবাদারেরা তাদের অফিসারের সামনে মন খুলে কথা বলতো না। উপরিঅলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রশ্নের জবাব দিতো।
সেপাইদের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে যখন অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে, জনগণের মনোভাবও তখন সরকারের প্রতি প্রসন্ন নয়। প্রেসিডেন্সী শহরগুলোর মাত্র অল্প সংখ্যক শিক্ষিত লোক সরকারের শাসনব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে ভালো বলে গ্রহণ করতে পেরেছেন। উত্তর ভারতের একজন অধিবাসী কলকাতার বাবুদের বিদ্রূপ করে বলেছেন, “তারা শেক্সপীয়র, মিল্টন পড়াবার শিক্ষক এবং এটর্ণি হবারই উপযুক্ত।” এই শিক্ষিতরাও কিন্তু সকলে ইংরেজদেরকে সমর্থন করতো না। বাঙলার একজন শিক্ষিত হিন্দু অভিযোগ করেছেন, “একশো বছরের নির্মম অত্যাচারের দাগ কোনো মহত্বের স্পর্শে মুছে যাবার নয়।” এদেশের হিন্দু এবং ইংরেজরা একশ বছর ধরে পাশাপাশি বাস করলেও তারা বন্ধু কিংবা শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীতে পরিণত হতে পারেনি। শাসক গোষ্ঠির সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই বিদ্রোহের সময়ে যে অসন্তোষ বিরাজ করেছিলো তার একটি প্রধান কারণ বলে শানোন-এর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ভার্ণির ধারণা। আমার মনে হলো ইংরেজ অধিবাসীরা এদেশীয়দের প্রতি অনেকটা বিতৃষ্ণ, তা তাদের আচার আচরণেই দেখতে পেলাম। আমার ধারণা, ভারতের প্রতিটি ইংরেজের মনে এদেশীয়দের প্রতি যে গভীর ঘৃণাবোধ ছিলো তা-ই বিদ্রোহের একটি কারণ। এদেশীয়দের প্রতি ইংরেজরা যখন কোনো দয়া করতেন, তখন তাঁদের চোখে-মুখে ঘৃণাবোধটাই সুস্পষ্টভাবে প্রকটিত হয়ে উঠতো। এমনকি যাজক এবং অন্যান্যরা, যারা হিন্দুদের ভালো করতে চেষ্টা করতেন, তারাও আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, যারা আমাদেরকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে, তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে হয়। আমাদের ভোলা উচিত নয় যে মুষ্টিমেয় বিদেশী-যারা অসংখ্য বিদেশীর উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তারা যদি এদেশের জনস্রোতে মিশে যেতে রাজী না হন, তাহলে তাদেরকে একটি সংঘবদ্ধ একক হিসাবে একটি উন্নত সম্প্রদায় বলে নিজেদের প্রমাণিত করতে হবে। অন্যথা, শুধুমাত্র নিরাপদ ব্যবধানে রেখে তারা শাসিতদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। শাসক এবং শাসিত দু’শ্রেণী যখন দু’টি বিভিন্ন জাতি তখন জাতিগত কৌলীন্য থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন মারমুখী প্রভেদ ঘুচাবার মধ্যপন্থা বের করে নেয়া সত্যিই অসম্ভব। ভারতীয়দেরকে ইংরেজরা সব সময় অবজ্ঞা করতেন। কোম্পানীর বিশ্বস্ত কর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ খান বলেছেন, প্রথমদিকের বছরগুলোতে জনগণ কোম্পানীর শাসন পছন্দ করেছিলো। তিনি বলেন, “সরকার আপনা থেকেই জনগণের শুভেচ্ছার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং সেজন্য সঙ্গত কারণেই জনগণ মনে করে যে তাদের সঙ্গে অসম্মানজনকভাবে আচরণ করা হয়। একজন ডিউকের কাছে একজন সাধারণ অফিসারের মূল্য যতোটুকু একজন এদেশীয় ভদ্রলোককে ঐ অফিসার এতোটুকু মূল্যও দেন না। একথা সরকার ভালোভাবে জানেন না যে অভিজাত দেশীয় ভদ্রলোকদের কোম্পানীর অফিসারের সামনে আসতে হৃদকম্প হতো আতঙ্কে। কিশোরীচাঁদ মিত্র, যিনি নিজেকে অনুগত নাগরিক এবং শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিভূ বলে দাবি করতে পারেন, তিনিও নালিশ করেছেন যে, ইউরোপীয় অফিসারদের রুষ্ট মেজাজই তাদের সাধারণ জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলো। তাঁদের মধ্যে তার ফলে আসমান জমিন দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিলো এবং একে অন্যের মনোভাব বুঝতে পারতো না। ইংরেজরা ভারতীয়দের থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। রাসেল বারানসী যাবার সময় লক্ষ্য করেছেন, কোনো সাদা মানুষের গাড়ির প্রতি জনসাধারণ প্রতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়নি। তিনি বলেছেন, সে চোখের ভাষা কে পারে ভুল বুঝতে? শুধুমাত্র তা থেকেই আমি জানতে পারলাম আমার জাতকে এক সময়ে অনেকে ভয় করেছে, এখন ঘৃণা করতে শুরু করেছে।