অনেক সময় বাঙালি পল্টনের জুনিয়র অফিসারদের অবিমৃষ্যকারিতা সামরিক আইনের বাইরে চলে যেতো এবং প্রকাশ্যে তারা নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতেন। জন জেকব বেদনাদায়কভাবে অফিসারদের মধ্যে উচ্চ নৈতিকতাবোধ এবং এ্যাংলো স্যাকসন সতোর অভাব দেখেছেন। একজন জুনিয়র অফিসার অনেকগুলো চাকর বাকর রাখতেন। তিনি রৌদ্রে যাবেন না, ঘোড়ার বদলে পাল্কীতে চড়ে ভ্রমণ করবেন। অন্য লোক তাঁকে পায়খানা ও প্রস্রাবখানায় নিয়ে যাবে। তার একজন খানসামা, একজন পরিচারক, একজন সর্দার বেয়ারা এবং অনেকগুলো বেয়ারা না হলে চলবে না। তাছাড়াও তাঁর বহু চাকরের প্রয়োজন। একজন হুঁকো বইবে, একজন বইবে ছাতা, একজন পানপাত্র এগিয়ে দেবে, চেয়ার এগিয়ে দেবে একজন। বলাই বাহুল্য সকল কাজ একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। ভারতে বসবাসকারী একজন সাধারণ ইউরোপীয় নিজের পানি উঠাতে পারেন না, নিজের পাক নিজে করতে পারেন না। এমন কি নিজের দাড়িও নিজে কামাতে পারেন না। অফিসারদেরকে সকালবেলা আধো ঘুম, আধো জাগ্রত অবস্থায় নাপিতেরা গিয়ে দাড়ি কামিয়ে দিয়ে আসতো। এ ধরনের আরাম-আয়েসের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়তো। জুয়া ইত্যাদি না খেললেও তাদের ন্যায্য মাইনের সাহায্যে এতো খরচ মেটানো সম্ভবপর ছিলো না। জুয়া খেলা ছিলো সামরিক মেসে একটি নিত্যনৈমিত্তিক প্রথা। তাই তাদের সব সময়ে দেনাদার অবস্থাতেই কাটাতে হতো। পাওনাদারদের দাবি মেটানোর জন্য তাদের অন্যায় পথ অবলম্বন না করে উপায় থাকতো না অনেক সময়ে। আরো আগে যে বেরিলীর বাঙালি কেরাণীর কথা উল্লেখ করেছি তিনি সেপাই, অশ্বারোহী এবং ইউরোপীয় অফিসারদেরও চড়া সুদে টাকা ধার দিতেন। ভারতবর্ষে দেনাদারদের প্রতি এক ধরনের অনুকম্পা মিশ্রিত মনোভাব প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। অফিসারদের তাঁদের অধীনস্থ দেশীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে সম্মান হারানোর কোনো ভয় না থাকলেও তাদেরকে কিছু কিছু সুবিধা দেয়া হতো। বাঙালি কেরাণী সরকারি তহবিল থেকে টাকা ধার দিতো না। কিন্তু সীতারামের কথামতো প্রত্যেক পে হাবিলদার অফিসারদের প্রয়োজনের সময় তহবিল থেকে টাকা ধার দিতেন। সীতারাম বলেছেন পে হাবিলদারেরা সাহেবদের টাকা ধার দিতেন। সমস্ত অফিসারের মাইনে তাঁদের হাত দিয়ে বিলি হতো বলে টাকা মারা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। কোনো অফিসার মারা গেলে আমরা সে দাবি তুলতাম না। এ ছিলো নিষিদ্ধ প্রথা। একবার শুনলে তার জন্য শাস্তি পেতে হতো। অফিসারেরা যথেষ্ট মাইনে পেলেও তাদের খরচের জন্য সে টাকা যথেষ্ট ছিলো না এবং সকল সময়ে তাঁদের অভাব লেগেই থাকতো। আমাদের রেজিমেন্টে মাত্র দু’জন অফিসার ছিলেন, যারা কোনো কর্জ গ্রহণ করেননি। মাইনের বেশির ভাগ টাকা তারা ভোজানুষ্ঠানে, জুয়াখেলা এবং রেসের পেছনে খরচ করে ফেলতেন। বিবাহিত সাহেবদের প্রায়শ: দেনাদার থাকতে হতো। পে হাবিলদার হিসেবে সীতারাম তাঁর কাছে গচ্ছিত সেপাইদের পাঁচশ টাকা ধার দিয়েছিলেন। একবার এক দুর্ঘটনায় তার কোম্পানীর এক সাহেব সর্বহারা হয়ে পড়েন। তিনি তাঁকে পাঁচ’শ টাকা ধার দিয়েছিলেন। একবার এক দুর্ঘটনায় তার কোম্পানীর এক সাহেব সর্বহারা হয়ে পড়েন। তিনি তাঁকে পাঁচ’শ টাকা ধার দিতে বলেন। কিন্তু সীতারামের সঞ্চিত টাকা ধার দিয়ে ফেলায়, তিনি তাঁর হেফাজতে রক্ষিত সেপাইদের টাকা হাওলাত দিয়ে ফেলেন। সে অফিসারটি যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতে পারলেন না। সেপাইরা টাকা চাইলে সীতারাম তাদের দাবি মেটাতে পারলেন না। তার নামে কর্ণেলের কাছে নালিশ করা হলো এবং তাকে কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু সীতারাম সেজন্য ক্যাপ্টেনদের দোষী না করে দেশীয় সেপাইদেরকেই দোষী করেছেন।
ইউরোপীয়ান অফিসারদের হারেম, তাদের এবং তাদের অধীনস্থ সেপাইদের সখ্যতা সূত্র বলে বিবেচিত হতো। ধীরে ধীরে হারেমে দুর্নীতি ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের অধিকাংশ অফিসার তাদের সঙ্গে হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক রাখতেন। রেজিমেন্টের উপর এর খুব প্রভাব ছিলো। সেপাইরা সব সময়ে এমন ভাব দেখাতো, তাদের কাছে অনেক স্ত্রীলোক আছে যাতে করে অফিসারেরা তাদেরকে ঘুষ দেয়। আবার অনেক সেপাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে টাকার লালসায় আপন আত্মীয়াদেরকেও সাহেবদেরকে দিয়ে দিত। অবশ্য তাদের অনেকেই ছিলো নিম্নশ্রেণীর।
বলা হয়ে থাকে যে, বেদণ্ড তুলে দেয়ার কারণে সামরিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়েছিলো। সামরিকশৃঙ্খলা মহৎ, সূক্ষ্ম যা মানুষের উচ্চতরো অনুভূতিতে নাড়া দেয় তার উপরই নির্ভরশীল। শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতনের সাহায্যে সামরিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিন্তু শৃঙ্খলা বলার বদলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাঙালি পল্টনের অভিজ্ঞ সেপাইরা ভালোমানুষী ব্যবহারের ফলে উজ্জ্বল হয়ে পড়েছিলো। হেদায়েত আলী কঠোর শাস্তিদানের সুপারিশ করেছেন। বাঙালি পল্টনের সেপাইরা জুনিয়র অফিসারদের খারাপ গালাগালির কারণে মারমুখো হয়ে উঠেছিলো। তারা তাদের দুর্মুখ অধিনায়কদের বিরুদ্ধে সব সময় আপত্তিজনক কথাবার্তা বলতো। সবসময় তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতো, যার ফলে তার অধীনস্থ সেপাইদের ওপর যতোদূর অফিসারের নৈতিক প্রভাব ছিলো তা অবসিত হয়ে এলো। বিভিন্ন রকমের পেশাদার সৈন্যের সাহায্যে কোনো বিদেশী একটা দেশ যখন শাসন করে, শীগগির অথবা বিলম্বে তাতে বিদ্রোহ বিক্ষোভ ইত্যাদির উদ্ভব হবেই হবে। শাসকদের যুদ্ধ সেপাইরা এতোকাল ব্যস্ত ছিলো বলে আগে তা ঘটতে পারেনি। অপরিসীম বীর্যবান অধিনায়কদের অধীনে চাকুরি করার পেশাগত গর্বই এতোকাল তাদেরকে রাজভক্ত রেখেছিলো। খারাপ পদ্ধতি নৈতিকতাহীনতা এবং বিশ্বাসহীনতার কারণে বহুকাল আগেই সে গর্ব অন্তর্হিত হয়েছে।