একই বছরে বোলারামের ঘটনার অব্যবহিতকাল পরে নতুন ঘটনা সংযুক্ত হয়ে ঘটনার বেগকে আবেগ দান করলো। সরকারের জনহিতকর প্রত্যেকটি কাজকে ভারতীয় জনসাধারণ ঘোরতর সন্দেহের চক্ষে দেখতে আরম্ভ করেছে। রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা সরকার তাদের সামাজিক ব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত হানার জন্যই প্রবর্তন করেছে বলে তারা মনে করলো। সৌভাগ্যবশতঃ কলকাতা থেকে মিঃ এডমন্ডের লিখিত এক পত্রে তার নির্দেশ পাওয়া যায়। রেলগাড়িতে বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের বসবার জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা করা হয়নি। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণকে অস্পৃশ্য শূদ্রের সঙ্গে পাশাপাশি আসনে বসতে হতো। এতে করে তাদের শুচিতা রক্ষার কোনো উপায় ছিলো না। ভ্রমণকালে হয়তো উপোস করতে হতো। নয়তো সামাজিক প্রথা ভঙ্গ করে তাদের দৈনিক ক্রিয়াকর্ম বাদ দিতে হতো। সেজন্য তাদেরকে কড়া রকমের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এতেকরে অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়ে যেতো। সকলে বলাবলি করতে লাগলো-ম্লেচ্ছ শাসকেরা এদেশে অভিশপ্ত কলিকাল ডেকে আনতে চায়। মি: এডমন্ড তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন দেশের বিভিন্ন অংশ দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার অধীনে আনয়ন করা হয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে ধীরে ধীরে সমাজকাঠামোর পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এখন দরকার দেশে একটি ধর্ম প্রচার করে সকলের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা। এ হলো গিয়ে ধর্ম প্রচারকদের চরম ঔদ্ধত্য। সকলে বিশ্বাস করলো এ প্রচারপত্রখানা সরকারই সমস্ত অফিসারের কাছে বিলি করেছে। লেফটেন্যান্ট গভর্ণর অস্বীকার করে বলেছেন, এ প্রচারপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সংযোগ নেই। তারপরেও কিন্তু গণমনের সন্দেহ দূরীভূত হলো না। তার পরের বছরে সরকারের দু’টি ব্যবস্থার ফলে সংস্কারাচ্ছন্ন গণমনে সরকারের প্রতি সন্দেহ আরো ঘণীভূত হলো।
মেয়াদ ফুরালে ১৮৫৬ সালে লর্ড ডালহৌসী ভারত পরিত্যাগ করে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ভারতে আসেন লর্ড ক্যানিং। নতুন বড়লাট সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়নি তখনো। ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং হৃদয়ের যে ঔদার্যবলে ভারতের জনসাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন এবং ভারতবর্ষকে ইংল্যান্ডের জন্য রক্ষা করতে পেরেছেন, সে মহান গুণাবলী তখনো জনসাধারণের কাছে সম্পূর্ণ অবিদিত ছিলো। প্রথমে এসে যে দুটি ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন তার জন্য তিনি জনসাধারণের বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন। তাতে করে গুজব অনুসারে লোকে বিশ্বাস করলো কোম্পানী তাকে এদেশের হিন্দু-মুসলমানকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য পাঠিয়েছে বিলাত থেকে। লর্ড ডালহৌসী হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। আইনটি লর্ড ক্যানিং-এর অনুমোদন লাভ করে শাসনভার হাতে নেয়ার পয়লা বছরেই চালু করা হয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রথাটি চালু হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ সংস্কারের পুরোভাগে ছিলেন বাঙালি কৃতি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর বিধবা বিবাহের যুক্তির পশ্চাতে ছিলো শাস্ত্রের সমর্থন। এতে সংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা নয়। বিধবারা রাজী না থাকলে বিয়ে তো হওয়ার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে ভারতের বিভিন্ন অংশে অব্রাহ্মণ বিধবারা ইচ্ছে করলে আবার বিয়ে করে নতুন জীবনযাপন শুরু করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সাথে শাসকগোষ্ঠির কোনো সংযোগ ছিলো না। তারা মনে করতে লাগলো শাস্ত্র থেকে সামান্য রকম বিচ্যুত হওয়ার অধিকারও তাদের নেই। ব্রিটিশ সরকার এ ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করলো। যেহেতু আগে থেকেই তারা ধরে নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার তাদের খ্রীস্টান করার জন্য মতলব আঁটছে। সংস্কারাচ্ছন্ন অংশ শাস্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপকারী আইনের অপব্যাখ্যা করতে লাগলো। ধর্ম গুরুতর বিপদের সম্মুখীন, সারাদেশে এবং সেপাইদের ছাউনিতে ছাউনিতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়লো।
ঐ বছরের জুলাই মাসে জারীকৃত এক ইশতেহারের ফলে বাঙালি পল্টনে যে সকল শ্রেণী থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হতো, সে শ্ৰেণীসমূহকে সাংঘাতিকভাবে আহত করলো। দু’দুবার উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ সেপাইরা সাগর পাড়ি দিতে অস্বীকার করেছে। কিন্তু মাদ্রাজী সেপাইরা সাগর পাড়ি দিতে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেনি… যদিও চাকুরির চুক্তিপত্রে সাগর পাড়ি দেয়ার কথার উল্লেখ নেই, যদিও মাদ্রাজী সেপাইদের মধ্যে ব্রাহ্মণের অভাব নেই, তবু তারা দু’দুবার সাগর পাড়ি দিয়েছে। একই শর্তে বাঙালি পল্টনের ৬নং রেজিমেন্টকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ব্রহ্মদেশে গিয়ে যুদ্ধ করতে তাদের কোনো আপত্তি ছিলো না। তাই বলে একই নিয়ম ভবিষ্যতের সকল বাহিনীকে কেননা মেনে নিতে হবে সে কথা তাদের বোধগম্য নয়। লর্ড ডালহৌসী নির্দ্বিধায় ৩৮নং পদাতিক বাহিনীর রাজপুত এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে চুক্তির শর্ত রক্ষা করেছেন। ব্রহ্মদেশে গমনে অনিচ্ছুক সেপাইদেরকে কঠিন দণ্ড দান করার জন্য স্যার প্যাজেটের মতো কোনো শক্তিশালী সর্বাধিনায়কও ছিলো না। যে সকল সেপাই ব্রহ্মদেশে অবস্থান করছে, তাদেরকে দেশে আসতে দেয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তাই লর্ড ক্যানিং নতুন সংগৃহীত সৈন্যদের কাছে চুক্তির শর্তের ব্যাপারে কোনো রকমের নমনীয়তা প্রদর্শন না করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সংশোধিত আইনের ফলে সেপাইদের ধর্মীয় অনুভূতি যে আহত হতে পারে এ ছিলো তাঁর ধারণার সম্পূর্ণ অতীত। কারণ এ শর্তে ভর্তি হবে কি হবে না এ ছিলো সম্পূর্ণ তাদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একবার ভর্তি হয়ে গেলেই আফগানিস্থান অথবা ব্রহ্মদেশ অথবা সাগরের পাড়ের যে কোন দেশে যেতে আপত্তি করতে পারবে না। সর্বসাধারণের জন্য জারীকৃত ঢালাও নির্দেশ সেপাইদের সচকিত করে তুললো। তাতে ব্যক্তিগতভাবে সেপাইরা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মনে করতে লাগলো তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য সামরিক বাহিনীতে চাকুরির দরোজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। পূর্বপুরুষেরা পেশা গ্রহণ করা ছাড়া সেপাইদের গত্যন্তর নেই। কিন্তু পেশার জন্য পূর্ব পুরুষের ধর্মকে বিসর্জন দিতে হবে। তাদের মনে হলো সরকার ধর্মের প্রতি বিশ্বাসহন্তা ছাড়া আর কাউকে সম্মানজনকভাবে চাকুরিতে বহাল করবে না। ধর্ম বিশ্বাস হত্যা করার বদলে সে দৈনিক ডাল-রুটি সংগ্রহ করবে। তারা যদিও রেহাই পেয়েছে, তাদের ছেলেপিলে, নাতি কেউই এ জঘন্য প্রথা থেকে রক্ষা পাবে না। পাপের অন্নে তাদের জীবন ধারণ করতে হবে। এভাবে ইহকাল এবং পরকাল দুইই তারা হারাতে বাধ্য হবে। উচ্চবর্ণের তরুণেরা আবার তুলনায় অনেক কম সংখ্যায় সামরিক বিভাগে চাকুরির আবেদন করতে আরম্ভ করলো। পঞ্চাশ বছরের অসময়োচিত অসুচিন্তিত শাসনব্যবস্থার ফলে জনগণ ধরে নিলো এ ফিরিঙ্গী শাসককুল না করতে পারে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই।