গোপীনাথ নন্দী আরো বলেছেন, পাটওয়ারী অথবা গ্রামের হিসেব রক্ষকদের যখন দেবনগরী হরফে হিন্দী শিক্ষা করার প্রয়োজন দেখা দিলো, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাদেরকে খ্রীস্টান যাজক পরিচালিত বিদ্যালয়ে যেতে হলো। মুসলমান সহকারী কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খানের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের শিক্ষা ভাষা কিংবা হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এ তিনশ বয়স্ক মানুষকে সুসমাচার পড়তে হলো, প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে হলো। এবং বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য এক এক খণ্ড নতুন বাইবেল উপহার দেয়া হলো। যাজক কর্ণেল এবং পাদরী লেফটেন্যান্টের আদেশে সেপাইদের মধ্যে দেশীয় যাজকেরা খ্রস্টধর্ম প্রচার করতে থাকে। জেলা শাসকের অনুমতি নিয়ে কারাগারের কয়েদিদের কাছে পাদরীরা দৈনিক হাজির হতে লাগলো এবং পরিশেষে তিন’শ পাটওয়ারীর নতুন বাইবেল নিয়ে ঘরে ফেরা, দেশের জনসাধারণের মনোভাব সরকারের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিষিয়ে তুলেছিলো।
তারপরে ১৮৫০ সালের নতুন উত্তরাধিকারী আইন তাদের বিদ্বেষ বাড়িয়ে। তুললো। প্রকৃত প্রস্তাবে এই আইনের বলে ধর্মান্তরিতরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার লাভ করে। এই আইনের বিরোধিতা করার মতো কোনো কিছু ছিলো না। দেশের আইনের কোনো ক্ষতি না করলে সত্তাবে দীক্ষিত হওয়ার কারণে, পূর্বপুরুষদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায় মনে করতে লাগলো, নবদীক্ষিত খ্রীস্টানদের সুবিধা দেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠি এই আইনের সৃষ্টি করলেন। তাদের বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এবং কাজের মধ্যেও পক্ষপাতমূলক মনোভাবের অনুপ্রবেশ ঘটে। রাস্তা নির্মাণের সময় একটা দুটা মন্দিরকে ভেঙ্গে ফেলা হলো। অশিক্ষিত জনগণ মনে করতে লাগলো তাদের পবিত্র মন্দিরকে ভেঙ্গে ফেলবার জন্যই সরকার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের দৃষ্টিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কোন মর্যাদাই পেলো না। একইভাবে ইংরেজের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাও দেশের জনমতকে ইংরেজের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলো। হেদায়েত আলীর অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি সুপ্রাচীন পর্দা প্রথার ওপর আঘাত এসেছিলো। হাসপাতালে রোগীদের স্থান দেয়ার ব্যপারে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হতো না। অসহায় শিশুদেরকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে খ্রীস্টান হিসেবে বড়ো করা হতো।
১৮৫২ সালে ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলো। সাগরের ওপারে আবার সেপাইদের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিলো। লর্ড ডালহৌসী বাঙালি সেপাইদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কালাপানি অতিক্রম করতে বাধ্য করলেন না। তবে তাদের স্বেচ্ছাকৃত সাহায্যের জন্য অন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্যাজেটের শিক্ষার কথা ভুলে গিয়ে ৩৮ নং দেশী পদাতিক বাহিনী যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলো। লর্ড ডালহৌসী অত্যন্ত বিজ্ঞোচিতভাবে সেপাইদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত রইলেন। সেপাইদের মনে আফগান যুদ্ধের স্মৃতি এখনো জীবন্ত। সরকার এখানে তাদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার মতলব পরিহার করেনি, এ বিশ্বাস আবার তাদের মনে জাগরুক হয়ে উঠলো।
১৮৫৫ সালে একটি অতর্কিত ঘটনা ঘটে। এ থেকে সরকারের হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিলো। হায়দরাবাদের নিকটে বেলারাম নামক স্থানে কতিপয় মুসলমান অশ্বারোহী কর্ণেল কলিন মেকেঞ্জীর প্রাণের উপর হামলা চালায়। কারণ তারা মনে করেছিলো, কর্ণেল মেকেঞ্জী মুসলমানদের মুহররমের মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন। ভুলবশতঃ কর্ণেল মেকেঞ্জী এক আদেশ জারী করেছিলেন ২০শে সেপ্টেম্বর তারিখে। নির্দেশের মর্ম হলো ২২শে সেপ্টেম্বর রাত বারটা থেকে পরদিন রোববার রাত বারটা পর্যন্ত কোন মিছিল, শ্লোগান অথবা শোরগোল কেউ করতে পারবে না। ২১শে সেপ্টেম্বর যখন দেখলেন, ২৩ শে সেপ্টেম্বর হলো পরদিন। ঐদিন মিছিল বের না করলে চলে না। তাই তিনি পূর্বে জারিকৃত নির্দেশের সংশোধন করলেন। এ নির্দেশগুলো একটু অস্বাভাবিক ছিলো। প্রথম নির্দেশটি তো রীতিমতো আপত্তিকর। তার ফলে মুহররম এবং রোববারের উপাসনার সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরের দিনই সব নির্দেশ প্রত্যাহার করা হলো। ক্ষতি যা হবার ছিলো ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। সংশোধিত নির্দেশ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে মিছিল পরিক্রমা বন্ধই ছিলো। অশ্বারোহীরা রোষবশত: শনিবারে মিছিল তো বের করলোই শহরে প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে মিছিল পরিক্রমা করিয়ে ক্ষান্ত ছিলো না, এমনকি তারা নিষিদ্ধ সড়ক বেয়ে ব্রিগেডিয়ারের বাঙলোর দিকে ধাওয়া করলো। তখন তিনি বসে বসে কতক অফিসার এবং ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। গোলমাল, শোরগোল এবং উচ্চ মাতম শুনে তিনি স্পষ্টত:ই বিরক্ত হলেন। ব্যক্তিগতভাবে কর্ণেল মেকেঞ্জী মিছিলকারীদের বাধা দিলেন । তাদেরকে পেছনে হটতে বললেন। মিছিলকারী জনতার মধ্যে বিক্ষুব্ধ কয়েকজন জানালেন এ রাস্তা তাদের, তারা এর উপর দিয়েই যাবে। রাগে দিশেহারা কর্ণেল হঠাৎ মিছিলকারীর কয়েকজনের হাত থেকে নিশান কেড়ে নিলেন। জনতা পেছনে হটলো, তবে একটু পরে ফিরে এসে শুধু তার উপর নয়, কতিপয় ভদ্রমহিলা এবং অফিসারকেও আক্রমণ করে বসলো। তারা বেরিয়ে ছিলেন সান্ধ্যভ্রমণের জন্য। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা কর্ণেল কার্পেন্টারকে জানালো, তারা হচ্ছে সরকারের চাকর, সরকারের জন্য তারা প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু ধর্ম তাদের কাছে প্রাণের চাইতে প্রিয়। সে ধর্মকে অপমান করা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার এবং ব্রিগেডিয়ার মেজরের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কিছুতেই অস্ত্র সংবরণ করবে না। পরে একটি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করা হলো। সে কমিটি ব্রিগেডিয়ার এবং ব্রিগেডিয়ার মেজরের আচরণের কোনো খুঁতই ধরলো না। তবে ব্যক্তিগতভাবে লর্ড ডালহৌসীর আভিমত হলো তারা অন্যায় করেছেন। দু’জন ছাড়া ৩নং অশ্বারোহী বাহিনীর সমস্ত দেশীয় সেপাইদের বরখাস্ত করা হলো। বিশৃঙ্খল জনতাকে কেননা বাধা দিতে পারেনি, এ অপরাধে হিন্দু সেপাইদের শাস্তি দেয়া হলো।