পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন: সর্বভারতীয় পুঁজির পরিপ্রেক্ষিতে তার অবস্থান কোথায়? যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমস্যার কথা আগে বলেছি। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের সাংস্কৃতিক দিক যদি বিচার করি, তা হলে ভাষার প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। মোটামুটি ১১৯৫০-এর দশক থেকে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের মাধ্যমে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা তার স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র আর বিকাশের সম্ভাবনা খুঁজে পাবে। তখনও পর্যন্ত সর্বভারতীয় পুঁজি ভাষার প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল বলেই মনে হয়। একদিকে প্রশাসনিক কাজে ইংরেজির ব্যবহারিক সুবিধা, অন্য দিকে গণ-মাধ্যম হিসেবে হিন্দির প্রসার (বিশেষ করে বেতার ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে), এই দুই প্রবণতাই কাজ করেছিল। সেইসঙ্গে ছিল রাজ্যস্তরে আঞ্চলিক বুর্জোয়াশ্রেণীর আঞ্চলিক প্রভাববৃদ্ধির চেষ্টা–যেমন গুজরাট, তামিলনাড়ু অথবা অন্ধ্রপ্রদেশে। গত দশ-পনেরো বছরে বিশ্বায়ন ও আর্থিক উদারনীতির প্রেক্ষিতে সর্বভারতীয় পুঁজি নিশ্চিতভাবে মনস্থির করে ফেলেছে যে তার পছন্দের ভাষা হল ইংরেজি। এই পছন্দের ফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। কারণ এখন থেকে আধুনিকতার সবচেয়ে ঝকঝকে তকমাগুলো লাগবে ইংরেজি বলতে পারা সংস্কৃতির গায়ে। এর ধাক্কা যে শুধু বাংলাভাষা আর বাঙালি সংস্কৃতিকেই সামলাতে হবে, তা নয়। প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রেই মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এর উত্তর হিসেবে রাজ্য বা রাজধানীর নাম পালটে বাঙালিয়ানা জাহির করা নিতান্তই হাস্যকর অপচেষ্টা। আইন জারি করে কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ভাষা-সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আর নেই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিন্দি। হাজার হাজার প্রশাসনিক নির্দেশ আর কোটি কোটি সরকারি টাকা খরচ করে যা করা যায়নি, সিনেমা টেলিভিশনের বিনোদনের মাধ্যমে আধুনিক হিন্দির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র। ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলির পুনরুজ্জীবনের দুটি মাত্র উপায় খোলা আছে বলে মনে হয়। এক, পুঁজির প্রয়োজনের বাইরে এমন প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সুযোগ তৈরি করা যা পুঁজির নিয়মে নয়, নিজের নিয়মে চলতে পারে। এর শর্ত হল, উনিশ-বিশ শতকের জাতীয় আন্দোলনের সমকক্ষ এক প্রবল শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, যার কোনও সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় পথ হল পুঁজির আধুনিকতম প্রকরণ ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করে আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে হিন্দি ছাড়া তামিল, তেলুগু, মালয়ালম আর পঞ্জাবি এই দিক দিয়ে অনেক নতুন উদ্যম দেখিয়েছে, বিশেষ করে সিনেমা, টেলিভিশন, ভিডিও, পপ সংগীত, স্যাটেলাইট মাধ্যম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে। বাংলা যে এই দিক দিয়ে ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমাদের আধুনিকতা আসলে খুবই সেকেলে হয়ে পড়েছে। তাকে একালের উপযোগী করা প্রয়োজন। ইতিহাসের উত্তরাধিকার নিয়ে শুধু বসে থাকলে চলবে না, তাকে খাটাতে হবে, লগ্নি করতে হবে, নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার শ্রীবৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক সংস্কৃতি তা ছাড়া কখনও সমৃদ্ধ হতে পারে না।
.
টীকা
১. এ রকম ভয়ংকরী অল্পবিদ্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ Francis Fukuyana, The End of History and the Last Man (New York: Free Press, 1992).
২. যেমন Partha Chalerjec. Nationalist Thought and the Colonial World (London : Zed Books: Delhi : Oxford University Press, 1986) The Nation and Its Fragments (Princeton : Princeton University Press; Delhi : Oxford University Press, 1993).