মনে রাখা দরকার যে উত্তর ভারতের একটা বিরাট অংশ, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান, আধুনিক শিল্পায়নের দিক দিয়ে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়া জায়গা। ফলে সরকারি ক্ষেত্রে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের চাপ এড়িয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি জোগাড় করার সুযোগ সেখানে বেশি নেই। সুতরাং আর্থিক উদারনীতি ও সরকারি বিনিয়োগের সংকোচন উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণের কাছে নিম্নবর্ণের রাজনৈতিক চাপ এড়াবার কৌশল হিসেবে তেমন একটা কার্যকর নয়। উত্তর ভারতের উচ্চবর্ণ এখনও পর্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও রাষ্ট-পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের কায়েমি আধিপত্যের ওপর নির্ভরশীল। স্বভাবতই নিম্নবর্ণের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের সামনে পড়ে তারা প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের মধ্যে এখনও তারা সাময়িক আশ্রয় খুঁজে চলেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক গণিতের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টিকেও নিম্নবর্ণের জমায়েতের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট বাঁধতে হচ্ছে। ফলে উত্তর ভারতের জাতি বিপ্লব বেশিদিন আটকে থাকবে বলে মনে হয় না।
৩.
ইতিহাস নিয়ে তিনটি প্রবন্ধে আমার মূল প্রসঙ্গগুলি আবার ঘুরে ফিরে এসেছে পুঁজি, কৌমচেতনা, জাতীয়তা, রাষ্ট্র। আর একটি প্রেক্ষিত সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে: প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের জটিল, সংঘাতপূর্ণ, অথচ গভীর অনুরাগময় সম্পর্ক।
উনিশ শতকের গ্রাম বাংলা প্রসঙ্গে মার্কসের নোটবই থেকে অনুবাদ একটা কথাই জোর দিয়ে বলছে প্রায় একশো বছর ঔপনিবেশিক শাসনে পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থা আর সামাজিক স্থিতি প্রায় ধ্বংসের মুখে পৌঁছেছে, অথচ উন্নত পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার শর্ত তখনও অনুপস্থিত। ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংসাত্মক ভূমিকার পাশাপাশি যে পুনরুজ্জীবক ভূমিকার চিহ্ন ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময় মার্কস দেখেছিলেন, ১৮৮০-র দশকে তা সম্পূর্ণ অলীক প্রমাণিত হয়ে গেছে তাঁর কাছে। এই অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন কৃষিজীবীবহুল দেশে, বিশেষ করে রাশিয়া আর ভারতবর্ষে, কৃষক সমাজের নিজস্ব গতিপ্রকৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংস্পর্শে এসে তার নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার জন্ম দেবার ক্ষমতা–এই নিয়ে মার্কস বিশেষ কৌতূহলী হয়ে পড়েন। তারই প্রমাণ গ্রাম বাংলা সম্পর্কে তাঁর বিশদ নোট।
প্রসঙ্গটা ঘুরে আসে এই বই-এ অন্তর্ভুক্ত শেষ প্রবন্ধটিতে। সেখানে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, আধুনিক হওয়ার পরিপূর্ণ ইচ্ছা নিয়েও কেন যেন আমরা বারে বারে ইতস্তত করেছি, অন্যের সৃষ্ট আধুনিকতার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে রাজি হইনি। এখানে একাধিক দ্বন্দ্ব লক্ষণীয়, বিশেষ করে বাঙালির আধুনিকতার ইতিহাসে। একদিকে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র, ইতিহাসের গর্ব, রাষ্ট্রক্ষমতার দেখনদারি, সবই আমরা পেয়েছি। তার প্রমাণ, ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে জাতির আত্মগৌরবের ইতিহাস লেখার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু অন্যদিকে আমাদের মধ্যে সর্বাধুনিক নেতৃস্থানীয়দের চিন্তাতেও দেখি এমন এক আধুনিক জাতীয় সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা যাতে আছে এক কাল্পনিক ফেলে-আসা নিরিবিলি দ্বন্দ্বকলহহীন গ্রামসমাজের স্মৃতি, তার প্রতি গভীর মমতা; এমন এক আধুনিকতা যাতে প্রতিযোগিতার ধার নেই, লাভ-লোকসানের হিসেব কষার রূঢ়তা নেই, শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর মাপকাঠিতে সময় বা পরিশ্রমের মূল্য যাচাই করার কদর্যতা নেই। এই আধুনিকতায় পুঁজির স্থান আছে, কিন্তু তার কোনও দম্ভ নেই, একাধিপত্য তো অবশ্যই নেই।
বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে বাঙালির এই আধুনিক সংস্কৃতি কিন্তু পুঁজির সাম্প্রতিকতম প্রসার প্রচেষ্টার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে খুবই কষ্টে পড়েছে। প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে প্রথমে ঔপনিবেশিক প্রশাসনযন্ত্রের ছত্রছায়ায়, তারপর জাতীয় আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে আর স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। এখন রাষ্ট্রের আর সে ক্ষমতা নেই যে এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের সংস্কৃতির বাহক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর কার্যক্রমকে সে অনন্তকাল ভরণপোষণ করে চলে। বেঁচে থাকার তাগিদে সংস্কৃতিকে বাজারে নামতে হচ্ছে, যা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় হবারই কথা। কিন্তু তাতে প্রায় দেড়শো বছর ধরে লালিত ভদ্রলোকের সংস্কৃতি প্রবলভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু যে তার আধুনিকতার দাবি কিংবা বুদ্ধিবৃত্তির অহমিকা অস্বীকৃত হচ্ছে তাই নয়, তার বিনা কাজের উৎসব-প্রবণতা আর প্রতিযোগিতা-বিমুখ মনোভাব ভয়ানক নিন্দাবাদ কুড়োচ্ছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এই যে বাজার আর প্রতিযোগিতার চাপে নতুন প্রজন্মের বাঙালি বুঝি তার মাতৃভাষা আর সংস্কৃতির প্রতিই বিমুখ হয়ে পড়ছে।
ইতিহাসতত্ত্বের দিক দিয়ে দেখলে, আমার বিশ্বাস, এই সংকটেও মূলত পুঁজি আর কৌমচেতনার দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ ঘটেছে। ঔপনিবেশিক শাসনকালে পুঁজি-অধ্যুষিত বাজার আর আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার দাবি এসেছিল বাঙালি সমাজের সামনে। আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির স্রষ্টারা সেই দাবি মেটানোর চেষ্টা করেও এমন এক নতুন সামাজিকতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থার হুবহু অনুকরণ হবে না, যেখানে পুঁজি আর বাজারের প্রয়োজন সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে না, যেথানে প্রয়োজন-অতিরিক্ত সামাজিকতার আনন্দ আর মার্জিত চিত্তবৃত্তি সমাদৃত হবে। পুঁজির দাবি আর কৌমস্মৃতির প্রতি মমতা, এই দুই-এর যে সূক্ষ্ম ও জটিল মিশ্রণ তাঁরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই সূত্র আর বোধহয় কাজে লাগছে না–তার কার্যকারিতা ফুরিয়ে গিয়েছে।