ভারতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক তুমুল হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে। ইন্দিরা গান্ধীর দ্বিতীয় দফা রাজত্ব এবং তারপর রাজীব গান্ধীর আমলে একদিকে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ক্ষমতা, অন্যদিকে বেশ কয়টি রাজ্যে কংগ্রেস-বিরোধী দলের সরকার গঠন–এই অবস্থায় রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা দেবার জোরালো দাবি ওঠে। সেইসঙ্গে ছিল পঞ্জাবে খালিস্তানি আন্দোলন, অসমে ‘বিদেশি বিতাড়ন’ আন্দোলন, দার্জিলিঙে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন এবং কাশ্মীরে ভারত-বিরোধী আন্দোলন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে নতুন প্রস্তাব দেওয়ার জন্য গঠিত সারকারিয়া কমিশনের কাছে শুধু বিরোধীদলই নয়, এমনকী কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মন্ত্রিসভারাও দাবি করেছিল, রাজ্যের হাতে আরও ক্ষমতা চাই, রাজ্যের ব্যাপারে কেন্দ্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা চাই। সবকিছু মিলে যা অবস্থা ছিল, তাতে এমন অনুমান অসঙ্গত ছিল না যে গোটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটা নতুন করে না সাজালে সাংবিধানিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
১৯৯০-এর দশকে এই দাবি অনেক কমে এসেছে। তার কারণ এই নয় যে আগেকব দাবি অন্যায় বলে প্রমাণিত হয়েছে। আসল কারণ হল যে কেন্দ্রীয় রাজনীতির পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আগেকার কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা হঠাৎই কমে যায়। ১৯৮৯ থেকে নতুন দিল্লিতে পর পর যত সরকার গঠিত হয়েছে, তার একটারও ক্ষমতা ছিল না ইন্দিরা কংগ্রেসের কায়দায় রাজ্য রাজনীতির স্বাতন্ত্র সম্পূর্ণ অস্বীকার করে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক শক্তির ওপর নির্ভর করে দেশ চালানোর। প্রত্যেকটি সরকারের ক্ষেত্রে, এমনকী নরসিংহ রাও-এর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকারের ক্ষেত্রেও, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাশীল দলের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। অন্তত রাজ্য সরকারদের অযথা ঘাঁটিয়ে বিরোধিতা সৃষ্টি করার সামর্থ্য বা আগ্রহ তার ছিল না। তাই ১৯৭০ কিংবা ১৯৮০-র দশকের তুলনায় ১৯৯০-তে কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক সাধারণভাবে রাজ্যগুলির দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। এর পেছনে আরও একটা কারণ আর্থিক উদারনীতি এবং শিল্প বাণিজ্য কৃষি উৎপাদন ইত্যাদি নানা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা। এর ফলে আগে যেখানে বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত শিল্প বাণিজ্য পরিচালনা অথবা নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাবের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির ওপর নির্ভর করে থাকতে হত, এখন লাইসেন্স-প্রথা প্রায় উঠে যাওয়ার ফলে সেই অবস্থা একেবারে পালটে গেছে। এর সুযোগ অবশ্য এক-এক রাজ্য এক-এক ভাবে নিতে পারছে–সকলে যে নতুন ব্যবস্থায় খুশি, এমন নয়। কিন্তু কেন্দ্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ অথবা বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে আগে যেমন অভিযোগ শোনা যেত, এখন তা অনেক কম শোনা যায়।
এই অবস্থা সাময়িক। যেহেতু বেশির ভাগ সময় কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার চলছে, এবং হয়তো আগামী কিছুদিন চলবে, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লাটা আগের তুলনায় অনেকটা রাজ্যগুলির দিকে ঝুঁকে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কেন্দ্রে বহুদলীয় সরকার মানে আসলে বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির কেন্দ্রীয় স্তরে বাড়তি প্রভাব। এই অবস্থা যতদিন চলবে, ততদিন বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই হয়তো রাজ্যস্তরের দাবিদাওয়া মিটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। যদি কেন্দ্রে আবার ইন্দিরা কংগ্রেসের মতো কোনও একদলীয় কেন্দ্রীভূত সংগঠন ক্ষমতায় আসে, তা হলে নিমেষের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
অন্য এক ধরনের সম্ভাবনার কথাও ভেবে রাখা উচিত। তা হল বর্তমান রাজ্যস্তরের নীচের আঞ্চলিক দাবিকে ভিত্তি করে আন্দোলন। এই ধরনের আন্দোলন কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কম দেখা যায়নি। উত্তরাখণ্ড, ঝাড়খণ্ড, গোর্খাল্যান্ড–এ সবই এই ধরনের আন্দোলন। কিছুদিন আগে নতুন সমর্থন জোগাড় করার আশায় ভারতীয় জনতা পার্টি এরকম বেশ কয়টি ছোট ছোট রাজ্য সৃষ্টি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। এই দাবি জোরদার হলে নতুন দুটি সম্ভাবনা দেখা দেবে। এক হল, বর্তমান বড় রাজ্যগুলি ভেঙে একাধিক ছোট রাজ্য গঠন। দুই হল, বর্তমান রাজ্যস্তরের নীচে আর একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় স্তর সৃষ্টি, যার ফলে বর্তমান কেন্দ্র-রাজ্য দ্বিস্তর কাঠামোর বদলে কেন্দ্র-রাজ্য-উপরাজ্য এই ত্রিস্তর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠিত হতে পারে। এক অর্থে এরকম তৃতীয় স্তর এখনকার ব্যবস্থাতেও আছে–যেমন ত্রিপুরা উপজাতি অঞ্চল কিংবা দার্জিলিঙের ক্ষেত্রে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ। এই স্তরটির সংজ্ঞা আরও ব্যাপক ও নির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হলে তা এক নতুন যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামোর জন্ম দিতে পারে।
জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ নিয়ে কয়েক বছর আগে সারা উত্তর ভারত জুড়ে ভয়ানক হাঙ্গামা হয়েছিল। আসলে উত্তর ভারতে এই সমাজবিপ্লবের অস্থিরতা খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের বিদ্রোহ কয় দশক আগেই শুরু ও সম্পন্ন হয়। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে ব্রাহ্মণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন, গণতান্ত্রিক জমায়েত এবং সংখ্যাধিক্যের ক্ষমতার সমবেত প্রভাবে এক ধরনের নতুন স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে যাতে নিম্নবর্ণের কয়েকটি জাতির রাজনৈতিক আধিপত্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ-নীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি ছিল ব্রাহ্মণবিরোধী আন্দোলনের ডাকে ব্যাপক জমায়েত তৈরি করার ক্ষমতা। উত্তর ভারতের সাম্প্রতিক আন্দোলনে এই দুই প্রক্রিয়া আবার একত্র হয়েছে। তাতে একদিকে আছে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের ফলে এক নতুন নিম্নবর্ণের এলিট-শ্রেণীর উদ্ভব, অন্যদিকে দলিত বহুজন ভাবধারার আন্দোলনে সমস্ত নিম্নবর্ণ তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর জমায়েত সৃষ্টি। দুই-এ মিলে উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক আধিপত্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।