এ হল আধুনিক লিবেরালদের অধিকারতত্ত্ব ও সহনশীলতার নীতি। দার্শনিক অথবা সাংবিধানিক সমাধান হিসেবে এ তত্ত্বের যথেষ্ট জোর থাকলেও, মুশকিল হল বাস্তব রাজনীতির জগতে এমন আদর্শ সমাধানের শর্ত পূরণ হওয়া প্রায় অসম্ভব। যে সব বিষয় নিয়ে মতানৈক্য সবচেয়ে গভীর, সাধারণত সে সব বিষয় নিয়ে আন্দোলন ও উত্তেজনাও সবচেয়ে প্রবল। সুতরাং এইসব উত্তেজক বিষয় রাজনীতির গণ্ডির বাইরে সরিয়ে দাও বললেই তো আর সকলে তা মেনে নেবে না। আন্দোলন আর উত্তেজনা তীব্র হলে রাষ্ট্রকেও হস্তক্ষেপ করতে হবে। তখন রাজনীতির ক্ষেত্র সীমিত রাখা যাবে কীভাবে?
আসলে লিবেরালদের ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়াটিকেই যথাসম্ভব রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ রাজনীতি কমাও, প্রশাসনিক প্রকরণ আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করো। এখানেই সাম্প্রতিক রাজনীতিচর্চার তৃতীয় প্রবণতাটির কথা এসে পড়ছে। এই প্রবণতাটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন মিশেল ফুঁকো। এক অর্থে প্রশাসনিক অন্তত উনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক রাষ্ট্রপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রশাসনিক প্রকরণই আসল কথা। সার্বভৌমত্ব, অধিকার ইত্যাদি নৈতিক শ্লোগান অপেক্ষাকৃত গৌণ। এখানে গণতন্ত্র মানে জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়। প্রশাসনযন্ত্রের কাছ থেকে প্রত্যাশামতো কাজ কিংবা সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে কি না, জনগণ কেবল সেটাই যাচাই করতে চাইবে। এর ফলে নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ নেওয়ার প্রবণতা অনেক কমবে। ভোট দেওয়ার ইচ্ছা, রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে কৌতূহলী হওয়া, এ সবই অনেক স্তিমিত হয়ে আসবে। অন্যদিকে বহুগুণে বাড়বে প্রশাসনিক প্রকরণ, জনগণের বিভিন্ন অংশের আচার-আচরণ প্রয়োজন প্রত্যাশা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রশাসনিক সমাধান বাতলে দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের দল। সম্প্রতিকালে প্রশাসনিকতার ব্যাপ্তি নিয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল বিশ্বজুড়ে এইসব প্রকরণ ও তার আনুষঙ্গিক জ্ঞানপ্রক্রিয়ার প্রসার। জনকল্যাণ, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম, ত্রাণকার্য, পুনর্বাসন, জনস্বাস্থ্য, সাক্ষরতা, প্রশাসনিক শিক্ষার প্রসার–এইসব কাজে ব্যবহৃত প্রশাসনিক প্রকরণ আজ আন্তর্জাতিক স্তরে সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে সে সব প্রকরণ এখন কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হাজার-হাজার বেসরকারি সংস্থার কাছেও পৌঁছে গেছে। ভাল করে দেখলেই দেখা যাবে যে এই সব প্রশাসনিক প্রকরণ সাংবিধানিক চরিত্র অথবা রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে সব দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একই কাজে এবং একই উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রশাসনিকতার এই প্রায়-সর্বজনীন প্রসার এক অর্থে লিবেরাল বর্ণিত রাজনৈতিক বিবাদের তাপমাত্রা কমানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। উত্তর আমেরিকা কিংবা পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে দেখা যাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভেতর রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রায় কোনও পার্থক্যই নেই। সব দেশেই নাগরিকদের মধ্যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক বিষয়ে উৎসাহ নেওয়া, ভীষণভাবে কমে গেছে। ভোট দেওয়ার হারও অত্যন্ত কম। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও প্রবণতা এইদিকে। ভারতবর্ষের মতো দেশেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতি, ঘন ঘন সরকার বদল, ঘন ঘন নির্বাচন–এত সব সত্ত্বেও বিভিন্ন দলের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের মধ্যে তফাত খুবই সামান্য। এক দলের সরকার চলে গিয়ে অন্য দলের সরকার এলেও আর্থিক-প্রশাসনিক নীতি কিংবা কাজকর্মের প্রায় কোনও পরিবর্তনই হয় না। যে সব বিষয়ে বাদানুবাদ এবং বিরোধ খুব তীব্র, তা হল ধর্ম-জাতি-অঞ্চল-সম্প্রদায় ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অধিকার দাবি করা, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তাদের যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব আদায় করা এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ভাগ নিজের গোষ্ঠীর সুবিধার জন্য টেনে নেওয়া। এইসব আপাত রাজনৈতিক বিরোধ যে আসলে প্রশাসনিকতার প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে, তারই রূপরেখা অনুযায়ী পরিস্ফুট হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে সাময়িকভাবে নিপুন্ন হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আগামী শতাব্দীতে কোনও এক নতুন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি যদি গড়ে ওঠে, তবে তাকে এই প্রশাসনিকতার যন্ত্রজালের মোকাবিলা করতেই হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, প্রশাসনিকতার প্রকরণ-নির্ভর, বিশেষজ্ঞ-নির্ভর প্রক্রিয়ার একমাত্র যোগ্য উত্তর আসতে পারে নতুন কোনও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠলে। আবার বলছি, আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক নতুন কৌমচেতনাই এমন রাজনৈতিক আন্দোলনের উপযুক্ত অবলম্বন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে একশো-বিশ বছর আগে কার্ল মার্কসের ভাবনা মোটেই অমূলক নয়।
২.
জাতীয়তা নিয়ে আমি নানাসময় বিস্তারিত লিখেছি। এই বই-এ সংকলিত প্রবন্ধগুলি ভারতের জাতীয়তা প্রসঙ্গের দুটি বিশেষ দিক সম্বন্ধে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এক হল, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আর দুই, জাতিভিত্তিক দাবি নিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতি। দুই বিষয়েই আমার মত খুব স্পষ্ট। গণতন্ত্রের প্রসার হতে হলে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যাপক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আর দেশের বর্তমান জাতি-শ্রেণী আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে দলিতবহুজন গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আগামী দিনে নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে বলে আমার ধারণা।