এহেন কৌমসমাজ আধুনিক সোসাইটি সমাজের বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। বস্তুত, পুঁজিবাদী সমাজের পরিপূর্ণ বিকাশের আবশ্যিক শর্ত হল কৌমসমাজের অবলুপ্তি। অর্থাৎ পুঁজি আর কমিউনিটি একে অপরের বিরোধী। এই কারণে মার্কসবাদী আলোচনায় সাধারণভাবে কৌমসমাজের প্রবক্তাদের সনাতনপন্থী, রক্ষণশীল কিংবা রোমান্টিক বলে ভাবা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে রাশিয়ার বিপ্লবীদের মধ্যে নারদনিক আর মার্কসবাদীদের বিতর্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। কৃষকসমাজকে আরও শক্তিশালী করে পুঁজির প্রসার রোধ করা যাবে এবং পুঁজিবাদের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে সরাসরি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে, নারদনিকদের এই ধারণাকে লেনিন নির্দয়ভাবে আক্রমণ করেন। সেই থেকে অন্তত মার্কসবাদী তত্ত্বের আলোচনায় কৌমসমাজকে আধুনিক সমাজতন্ত্র কিংবা বিপ্লবোত্তর সমাজগঠনের অঙ্গ হিসেবে আর ভাবা হয়নি।
বিপ্লবী রাজনীতির কৌশল হিসেবে কিন্তু চীন অথবা ভিয়েতনামে, কিংবা আরও সাধারণভাবে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার কৃষিজীবীবহুল দেশগুলিতে, কৃষকসমাজের আভ্যন্তরীণ শক্তি, পুঁজির বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা, এমনকী পুঁজি-অধ্যুষিত বাজার, ঋণ ও বণ্টনব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অথবা বোঝাঁপড়ার জন্য কৃষকসমাজের ভেতর নতুন নতুন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা–এ সবই কিন্তু লক্ষ করা হয়েছে, আলোচিত হয়েছে এবং বিপ্লব-প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় যেটা লক্ষণীয়, তা হল এই কৌশলগত ভাবনাগুলোকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির তত্ত্বের স্তরে নিয়ে যাওয়া। সোভিয়েত সমাজবাদের বিপর্যয়ের পর এখন সুযোগ এসেছে নতুন করে সমাজতন্ত্রের গঠন, বিন্যাস, চরিত্র নিয়ে তত্ত্ব কল্পনার জানলা-দরজা খুলে দেওয়ার। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কসের শেষ জীবনের লেখা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৮০-র দশকে।
ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রসঙ্গে অনেক কিছু শেখার আছে বলে আমার বিশ্বাস। একদিকে ভারতীয় কৃষকের জীবনে পুঁজির অনুপ্রবেশ কোনও না কোনওভাবে অন্তত গত একশো-দেড়শো বছর ধরে ঘটে চলেছে। আজকের ভারতবর্ষে পুঁজির। উপস্থিতি, আধিপত্য এবং প্রসার প্রশ্নাতীত। অথচ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভারতে আধুনিক পুঁজির বিস্তার যে অপেক্ষাকৃত মন্থর, তার কর্তৃত্ব যে নানাভাবে। খর্বিত, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। আবার সেইসঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে দেখা গেছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দ্রুত ও ব্যাপক প্রসার। এই গণতন্ত্র কতটা বুর্জোয়া, আর কতটা তা কৃষক-কৌমসমাজের আচার-আচরণ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিসারিত ব্যঞ্জনা, তা বিচারসাপেক্ষ। কৌমসমাজ মানেই যে তা সনাতনপন্থী, অনড়, পরিবর্তনবিমুখ, এমন কথা অন্তত আধুনিক ভারতবর্ষে বসে বলা সম্ভব নয়। অথচ ভারতীয় কৃষক আধুনিক পুঁজি আর আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কোন উপায়ে, কী কী শর্তে এবং কোন উদ্ভাবনীশক্তির সাহায্যে আপন করে নিয়েছে, তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা প্রায় শুরুই হয়নি বলা চলে। বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে যে অভূতপূর্ব সমাজ-সংগঠন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় তার থেকে শিক্ষণীয় বহু জিনিস আছে। এ নিয়ে যথার্থ তাত্ত্বিক আলোচনা হয়নি বললেই চলে। এমনকী, উপযুক্ত তত্ত্বের অভাবে এই ঐতিহাসিক উদ্যোগ বিফল অথবা বিপথগামী হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। এই তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু করতে গেলে পুঁজি আর কৌমসমাজের আপাতবিরোধিতার জায়গা থেকেই শুরু করা প্রয়োজন বলে আমার ধারণা।
রাষ্ট্র-প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনায় দ্বিতীয় যে প্রবণতার কথা বলেছি, তা হল রাজনৈতিক বিবাদের সীমানা সংকুচিত করে দেওয়ার তত্ত্ব। এটা প্রধানত লিবেরাল মতাবলম্বীদের প্রস্তাব। এখানে মূল ধারণা হল, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আইন বা প্রশাসন সংক্রান্ত যত বিতর্ক, তা কেবল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং প্রয়োজন হলে ভোট গুণে নিষ্পত্তি করা উচিত। কিন্তু যে সব বিষয়ে বিভিন্ন মতের মধ্যে বিরোধ এত গভীর যে কোনও আলোচনা অথবা পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কী করে? যদি ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তা হলে যারা সংখ্যালঘু তারা অবশ্যই মনে করবে যে সমাজ বা ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে তাদের মৌলিক বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা অশ্রদ্ধা বা অস্বীকার করছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে রাষ্ট্রের মূল গঠননীতি নিয়েই প্রবল মতানৈক্য দেখা দেবে। বস্তুত, সংখ্যালঘু মতাবলম্বীরা রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেবে। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাই দু-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে।
এই বিপর্যয় এড়াতে হলে দরকার দলমতগোষ্ঠী-নির্বিশেষে একটা সাধারণ স্বীকৃতি যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সব বিষয়ে সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়, সে সব বিষয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের আওতায় আদৌ আনা হবে না। অর্থাৎ সকলে মেনে নেবে যে এই ধরনের বিষয় সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে, অর্থাৎ নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অথবা আইনসভায় প্রস্তাব হিসেবে কেউ তুলবে না। ওই বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চাওয়া হবে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের বাইরে, অর্থাৎ বৃহত্তর সামাজিক জীবনে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা মতাবলম্বীর মধ্যে সহাবস্থান বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ সকলকে মেনে নিতে হবে যে অন্য গোষ্ঠীর আচার-আচরণ যদি পছন্দসই না-ও হয়, তা হলেও নিজস্ব সামাজিক ক্ষেত্রে সেই গোষ্ঠীর নিজেদের মতবিশ্বাস অনুসারে জীবনযাপনের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।