কলেত্তি প্রসঙ্গে আমার আলোচনায় একটা মন্তব্য করেছিলাম যা আজকে, সোভিয়েত সমাজবাদের বিপর্যয়ের পর, অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা দরকার। বিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদী রাজনীতি-চিন্তায় বিপ্লবের রণকৌশল, পার্টির সংগঠন, বিপ্লবোত্তর সমাজে পার্টির নির্ণায়ক ভূমিকা–এইসব বিষয় এত বেশি প্রাধান্য পেয়েছে যে আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের মূল প্রতিপাদ্যগুলো নিয়ে মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায় কোনও মৌলিক আলোচনাই নেই। আজ যখন বিপ্লবচিন্তায় ভাটা পড়েছে, আবার সুযোগ এসেছে রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে মার্কসের লেখায় ফিরে যাওয়ার।
পুঁজির বিশ্লেষণের পাশাপাশি আধুনিক রাষ্ট্র নিয়ে মার্কসের চিন্তায় দুটো দিক লক্ষ করার আছে। একদিকে মার্কস দেখাচ্ছেন যে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার শ্লোগান পুঁজির অবাধ বিচরণ ও প্রসারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ পুঁজি-অধ্যুষিত সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা অথবা সকলের সমান। অধিকার মোটেই ফাঁকা বুলি নয়, কিংবা শ্রমিকের চোখে ধূলো দেবার কৌশল নয়। সাম্য-স্বাধীনতা হল উত্তমূল্য আহরণ ও পুঁজির সম্প্রসারণের আবশ্যিক আইনগত শর্ত। এইজন্য প্রাক-ধনতান্ত্রিক ভূসম্পত্তি, ভূস্বামীর কাছে ভূমিদাসের বশ্যতাস্বীকার, দৈনন্দিন জীবনে এই বশ্যতা কার্যকর করার জন্য যতরকমের সামন্ততান্ত্রিক আচার অথবা বিধান–এ সবই আধুনিক ধনতন্ত্রের পরিপন্থী। অন্যদিকে কিন্তু মার্কস আবার এমন দাবিও করছেন যে বিপ্লব-পরবর্তী সমাজের আসল লক্ষ হবে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবাধ প্রসার, সাম্য ও স্বাধীনতার নীতিকে প্রতিনিধিত্বমূলক বুর্জোয়া সাংবিধানিক ব্যবস্থার কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে দৈনন্দিন ও স্থানিক জনজীবনে কার্যকর করে তোলা। এদিক থেকে দেখলে মার্কসের রাষ্ট্রতত্ত্ব আসলে রুসোর অবাধ গণতন্ত্রের অবিকল প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়।
মার্কস ঠিক কী বলেছিলেন অথবা বলেননি, সেটা তত জরুরি প্রশ্ন নয়। জরুরি প্রশ্ন হল, বিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় রাষ্ট্র নিয়ে কী ভাবা হয়েছে? এ প্রশ্নের সঠিক ও নির্মম উত্তর হল, বিশেষ কিছুই ভাবা হয়নি। কি সোভিয়েত সমাজবাদে, কি চীনে, কি কিউবায়, একটা জগাখিচুড়ি সাংবিধানিক ব্যবস্থা খাড়া করা হয়েছে ঠিকই। তাতে ব্যক্তির অধিকার, গোষ্ঠীর অধিকার ইত্যাদি নানা বুর্জোয়া সাংবিধানিক উপাদান জড়ো করা হয়েছে। একটা প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু তাতে বুর্জোয়া নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রাণশক্তি অনুপস্থিত। তার বদলে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে রেখেছে। বিপ্লবোত্তর সমাজ নির্মাণের প্রধান চালিকাশক্তি কমিউনিস্ট পার্টির একাধিপত্য। সবকিছুর মধ্যে এই ধারণাটাই কাজ করেছে যে এই রাষ্ট্রবিন্যাস একটা কাজ চালানোর মতো সাময়িক ব্যবস্থা। যখন সারা দুনিয়ায় পুঁজিবাদের অবসান ঘটবে, প্রকৃত সমাজবাদ অথবা সাম্যবাদ গড়ে উঠবে, তখন সমাজ প্রশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা তৈরি করা যাবে। যতদিন তা না হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রামের রণকৌশল অনুযায়ী। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার নীতিগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সময় এখনও আসেনি। এখন কৌশলগত প্রয়োজন মেটানোর দাবিটাই প্রধান।
‘গণতন্ত্রে মানবাধিকার’ বক্তৃতায় মন্তব্য করেছিলাম যে গোটা শতাব্দী জুড়ে সমাজবাদী রাষ্ট্রচিন্তার দৈন্যই শতাব্দীর শেষে তার বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। এখন নতুন শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তিন ধরনের ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এক হল, রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিপক্ষ বা বিকল্প হিসেবে এক ধরনের আধুনিক কৌমব্যবস্থার কল্পনা। দ্বিতীয়, দৈনন্দিন রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বা দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়ে নিষ্পত্তি করা যায় না, এমন সব বিতর্কিত বিষয়কে রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করা, অর্থাৎ সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রটাকেই সীমিত করে ফেলা। আর তৃতীয়, রাজনৈতিক বাদানুবাদ বা সংগ্রামের বদলে বিভিন্ন নিদিষ্ট সমস্যার প্রশাসনিক সমাধান খোঁজা। অর্থাৎ সোজা কথায় রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে প্রশাসনিকতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। ‘কৃষকবিদ্রোহ ও রাষ্ট্রবিপ্লব’, ‘গণতন্ত্রে মানবাধিকার এবং গ্রামশি ও মিশেল ফুঁকো’–এই প্রবন্ধগুলোতে ওই তিন ধরনের রাজনীতি চিন্তার আলোচনা করা হয়েছে।
মার্কসবাদী আলোচনায় কোম বা কমিউনিটির ধারণা থেকে ভয়ানক জটিলতা আর ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কৌমচেতনা প্রাকধনতান্ত্রিক সমাজের অঙ্গ। শিকার অথবা পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল তথাকথিত ‘আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৌমভাব স্বভাবতই প্রবল। এই ধরনের সমাজে শ্রেণীবিভাজন তেমনভাবে দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রসংগঠন হয় নেই অথবা খুবই দুর্বল। জাতি-গোষ্ঠী-আচার-লোকধর্মের ভেতরে বিন্যস্ত নানা নিয়মকানুন, বাধানিষেধ, কর্তব্য-দায়িত্বের জালে জড়িয়ে এই কৌমচেতনাই আদিম সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে কার্যকর রূপ দিতে সক্ষম হয়। অপেক্ষাকৃত উন্নত ও জটিল কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যদিও শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীদ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রও অনেক সক্রিয়ভাবে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট হয়, তা সত্ত্বেও বিরোধী শ্রেণীস্বার্থ ছাপিয়ে, অথবা বলা উচিত তাকে স্বীকার করেই, এক বৃহত্তর সামাজিক সমন্বয় বা ঐক্যের আদর্শ রূপায়িত হয়ে থাকে নানাস্তরে বিন্যস্ত কৌমব্যবস্থায়। ধর্ম, লোকাঁচার, মার্গসংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি, সবেতেই এই কৌমচেতনার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, সমাজদর্শনের ভাষায় এই কমিউনিটি (community) বা গেমাইনশাট (gemeinschaft) অর্থেই ‘বাংলা সমাজ’ শব্দটির অর্থ সবচেয়ে পরিস্ফুট, যদিও আধুনিক বাংলায় আমরা সোসাইটি (society) বা গেসেশাট (gesellschaft) অর্থেই সমাজ’ শব্দটা ব্যবহার করছি। আধুনিক সোসাইটি’ কিন্তু কৌমসমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধারণা। সোসাইটির সদস্য হল ব্যক্তিমানুষ। সোসাইটি তৈরি হওয়ার আগেও ব্যক্তিমানুষ তার ব্যক্তিচরিত্র ও স্বার্থ নিয়ে পুরোপুরি ব্যক্তি। অন্য ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতায় তার ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধ হবে, এই ভেবে ব্যক্তি সমাজের সদস্য হয়। অনুমান এরকমই যে স্বার্থসিদ্ধি না হলে সে সমাজের সদস্যপদ ত্যাগ করতে পারে। কৌমসমাজের গঠনতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে সমাজ শুধু ব্যক্তিসমষ্টির যোগফল নয়। সমাজ ব্যক্তির আগে, সমাজের দাবিই প্রধান। সে সমাজে ব্যক্তিসত্তা আদৌ স্বীকৃত হতে পারে না, এমন নয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্থান বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজন ও নিয়মের বশবর্তী।