সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কোড, শহরের অলিতে গলিতে রাস্তায়। শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে যাচ্ছি। পাড়ার রকে ক’টা ছেলে। সিরিয়াস আলোচনা— ‘জানিস তো, গেল রাতে মিত্তিরদের বাড়িতে যে চোরটা ধরা পড়েছিল, সবাই মিলে সেটাকে এমন সেঁকল যে আর একটু হলে খরচাই হয়ে যাচ্ছিল…তা হলে তো বিলা হয়ে যেত মাইরি।’ এই সম্পূর্ণ বাক্যটার মধ্যে অন্তত তিনটে কোড লুকিয়ে রয়েছে। ‘সেঁকল’ মানে প্রচণ্ড মার মারল। ‘খরচা’ হয়ে যাচ্ছিল অর্থাৎ মরে যাচ্ছিল। সবশেষে ‘বিলা’-র মানে ঝামেলা বা গণ্ডগোল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটা কোড অত্যন্ত জনপ্রিয় শহর জুড়ে। ‘মুরগি’। ঠকে যাওয়া বা বোকা বনে যাওয়া মানুষের কোডনেম। এ ছাড়াও ট্যারা কাউকে ‘দেড় ব্যাটারি’ বা মেয়েলি ধরনের পুরুষকে ‘বউদি’ বলে হামেশাই ডেকে থাকি আমরা। কারও ঠকে যাওয়া, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা একটা অন্য ধরনের চালচলন নিয়ে রসিকতা, সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতার কাছে বিশেষ প্রাপ্তি বই কী। বলতে ভুলেই গেছি ‘স্যাঁকা’ ছাড়াও পেটানোর আরও চারটে কোড চালু আছে কলকাতায়। সেগুলি হল যথাক্রমে ‘সাইজ করা’, ‘বানানো’, ‘ক্যালানো’, আর ‘বাটামবাজি’। একই ভাবে ঘুসি মারারও তিনটে কোড— ‘টিক’, ‘ঠুসো’ আর ‘হাতোড়া’। এর মধ্যে শেষেরটা শোনা যাবে একমাত্র অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। ‘হাতোড়া’ হিন্দি শব্দটির বাংলা মানে হাতুড়ি। সেক্ষেত্রে হাতুড়ির মতো মুষ্ট্যাঘাত, এ ধরনের একটা সামঞ্জস্য খুঁজে নেওয়াই যেতে পারে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই অধম যখন ক্লাস এইট-নাইন, সে সময় প্রেমিকার দুটি কিউট কোডভাষা চালু ছিল উত্তর কলকাতায়— ‘ছাবি’ আর ‘ভাতি’। বর্তমানে অবশ্য বিলুপ্তপ্রায়। জলদাপাড়ার গন্ডার বা সুন্দরবনের বাঘের মতো সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়।
এবার যে কোডগুলির কথায় আসব তা একেবারেই শহুরে নয় এবং প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে আদৌ খাপ না খেলেও প্রচণ্ড ইন্টারেস্টিং। তাই বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। পেশাগত প্রয়োজনে বসিরহাট সংলগ্ন ঘোজাডাঙা সীমান্ত এলাকায় গেছি। সকাল সাড়ে দশটায় ব্যস্ত ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। ছোপ ছোপ হলুদ জলপাই উর্দির বিএসএফ। সাদা পোশাকের ডিআইবি। সারি সারি মানি এক্সচেঞ্জ স্টল। প্রচণ্ড ভিড় স্টলের সামনে। সীমান্ত পেরিয়ে মানুষজন এপারে আসছেন। ওপারে যাচ্ছেনও অনেকে। রাস্তার ধারে লাইনে দাঁড়ানো অটো। প্রাণপণে হাঁক পাড়ছে ড্রাইভাররা—‘বসিরহাট বসিরহাট…।’ একদম সামনের চালককে পেছনের চালক জিজ্ঞেস করছে— ‘তোর পোকায় কটা ধুর?’ সামনের জন— ‘ছটা’। ‘কটা সাফা, কটা ধাক্কা?’ প্রথমজন— ‘চারটে ধাক্কা দুটো সাফা।’ ‘তা হলে আর চিন্তা কী? তোর তো হয়ে গেল গুড়-রুটি। নে নে পোকা চালু কর, আমাকে ধুর ধরতে দে।’ কথা হচ্ছিল অত্যন্ত নিচুস্বরে। তবু চির-কৌতূহলী কান তার র্যাডারে তুলে নিল এই বিচিত্র কথোপকথন। দ্বিতীয় অটোওয়ালার অটো তখনও ভরেনি। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালাম পাশে। মনে দমচাপা কৌতূহল। দেশলাই চাওয়ার বাহানায় কথাবার্তা শুরু। সিগারেট জ্বালিয়ে ওকেও দিলাম একটা। মিনিট পাঁচেক বার্তালাপের পর উপরোক্ত কথোপকথনের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটিত হল। জানা গেল পোকা আসলে অটো। আর ‘ধুর’ শব্দের অর্থ বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষজন। ‘সাফা’ মানে যাদের কাছে আইনি পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি আছে। আর যারা বেআইনি পথে এপারে এসেছেন, স্থানীয় কোডে তারা ‘ধাক্কা’। এই ‘ধাক্কা’ জাতীয় ‘ধুর’-রা চালকের ‘পোকা’ থুড়ি অটোয় যত বেশি থাকবেন তার তত বেশি ‘গুড়রুটি’ বা পোয়াবারো। কারণ ‘ধাক্কা’দের ক্ষেত্রে অটোভাড়া ‘সাফা’র তুলনায় প্রায় তিনজন। আইনরক্ষকদের দিয়েথুয়েও বেশ ভালই থাকে। বিশ্বাস না হলে স্বগমনে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে চোখ কান একটু খোলা রাখতে হবে।
ফিমেল কোড। এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের। মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মহলে প্রচণ্ড জনপ্রিয়। দু’-এক টুকরো সংলাপ শোনাই। ধরুন দুটি অল্পবয়েসি মেয়ে। একজন অপরজনকে বলছে— ‘তুসপুই কোসমোসপোথায় যাসপাসছিস’, অপরজন— ‘মিসতাসের রাবড়ি’। এবার প্রথমজন— ‘আসফামি যাসপাচ্ছি ফাসনা।’ এটুকু শুনে কারও মনে হতেই পারে— যাঃ বাব্বা! হিব্রু না জুলু কোন ভাষায় কথা বলছে? অবগতির জন্য জানাই হিব্রু-জুলু-নেপচুনগ্রহ বা আলকায়দা কোনওটাই নয়। পাতি বাংলায় কথা বলছে এরা। ঘাবড়ে না গিয়ে ধৈর্য ধরে কথাগুলোকে ডিকোড করার চেষ্টা করুন। দেখবেন ব্যাপারটা একদম জলবৎ তরলং হয়ে গেছে। আসলে এটা আর কিছুই না একেকটা বাক্যের সামনে বা মাঝখানে কিছু অহেতুক অক্ষর জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। প্রকৃত সংলাপ—‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ ‘মিতাদের বাড়ি’, ‘আমি যাচ্ছি না’। ওপরের লাইনগুলোয় আর একবার চোখ বোলালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে সব খেলারই একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। এ খেলার নিয়ম হল একেকটি বাক্যের প্রথম অক্ষরটিকে যথাসম্ভব আর শেষ অক্ষরটিকে অবশ্যই সঠিক অবস্থানে রাখতে হবে। কথার গতিও হওয়া চাই বেশ দ্রুত যাতে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যারা আজ প্রথম এই খেলাটা শিখলেন, আজ থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করে দিন। পরিচিত মহলে সুপার ডুপার হিট হবেই। গ্যারান্টি।