ছোট বড় যে-কোনও অপরাধীরই শেষ ঠিকানা জেল। এখানেও রয়েছে একাধিক নিজস্ব ভাষা, যা জেলেই একমাত্র শুনতে পাওয়া যায়। যেমন ‘চৌকা’ মানে রান্নাঘর। ‘লালটোপি’— রেপকেসের আসামি। ‘চিল্লর’-চামউকুন। ‘পাগলি’-র অর্থ বিপদ সাইরেন। ‘পলিতা’-র অর্থ কেরোসিন ভেজানো ন্যাকড়ার সলতে জ্বালিয়ে কোনও বন্দির পায়ের পাতায় ‘ছ্যাঁকা’ দেওয়া। তবে কাউকে হেনস্থা করার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট পন্থাটি হল ‘পোচাড়া’ মানে ন্যাকড়ায় মলমূত্র মাখিয়ে গায়ে ছুড়ে মারা। আরও দুটো কোড বহুল প্রচলিত ছিল জেলে ষাট সত্তর দশকে। তবে অপরাধীদের নয়। রাজনৈতিক বন্দিদের মধ্যে। জেনারেল বডি মিটিং, সংক্ষেপে জিবি, ‘বড় কম্বল’ আর ছোট গ্রুপ মিটিং পরিচিত ছিল ‘ছোট কম্বল’ নামে। অপরাধ জগতের প্যাঁচপ্যাঁচানি তো সেরে ফেলা গেল মোটামুটি। চলুন এবার একটু নেশার দুনিয়ায় ঝিম খাই।
এই গোটা শহরটা জুড়ে, নেশারু আর নেশার উপকরণের ছড়াছড়ি। অলিতে গলিতে অজস্র বার, ঠেক আর জয়েন্ট। তালিকায় ‘র্যাঙ্কিং ওয়ান’ অবশ্যই মদ। এর একাধিক নাম, প্রায় কৃষ্ণের অষ্টতর শতনামের মতো। কত নামে যে রসিকরা আদর করে ডাকে! ‘তেল’, ‘জল’, ‘সাদাজল’, ‘লালজল’, ‘গরমজল’, ‘মাল’, ‘খাট্টু’, ‘পিকআপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি…। ঘরে তৈরি বেআইনি দেশি মদের নাম ‘চুল্লু’ বা ‘চৌ এন লাই’। আবার সরকারি দেশি মদেরও একাধিক কোডনাম রয়েছে সুরাপায়ীদের কাছে। ‘বাংলা’, ‘বাংলু’, ‘ব্যাং ব্যাং’। গাঁজার কোড— ‘তামাক’, ‘থাম’, ‘খাম’, এবং সাহেবি কেতায় ‘গ্রাস’। চরস পরিচিত ‘চেরি’ বা ‘পিচ’ নামে। ডেনড্রাইট ‘আঠা’। ফেনসিডিল বা কোরেক্স জাতীয় কাশির সিরাপের আদুরে নাম ‘জুস’। তবে সবচেয়ে রোম্যান্টিক কোড ম্যানডেক্স কামপোজ বা স্প্যাসমোপ্রক্সিভন জাতীয় নেশার ট্যাবলেটের— ‘চাঁদ কা টুকরা’। শিরায় মাদক নেওয়া নেশাড়ুদের কোড— ‘মেইনলাইনার’। গাঁজার কলকে মানে ‘বন্দুক’ আর কলকে প্যাঁচানোর ন্যাকড়া মানে ‘সাপি’। হেরোইন মানে ‘পাতা’ আর হেরোইনখোর মানে যে ‘পাতাখোর’ সেটা এখন পাড়ার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাও জানে। তাই এগুলোকে আর কোডের পর্যায়ে ফেলছি না।
এবার যে দু’টো দুনিয়ার কথা বলব তাদের ব্যবহৃত কোডগুলো একান্তই তাদের নিজস্ব এবং এক্সক্লুসিভ। সেগুলো হল নিষিদ্ধপল্লী আর হিজড়ে সমাজ। লালবাতি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী যৌনকর্মীদের বলা হয় ‘পার্মেন্ট’ (পার্মানেন্ট)। ঠিক একই ভাবে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘ফেলাইন’ (ফ্লাইং) নামে। বহু জায়গায় মদের একাধিক কোডনেম শুনেছি কিন্তু ‘কেরোসিন’ কোথাও শুনিনি। এটা একান্তভাবেই এ পাড়ার নিজস্ব। এ ছাড়াও এই এলাকায় দেশি মদের আরেক নাম ‘ক্যান্টি’ (কান্ট্রি লিকারের অপভ্রংশ বোধ হয়)। ‘দাল্লা’ বা ‘ভেরুয়া’-র অর্থ এখানে দালাল। ‘ক্যাসেট’ মানে পাচার হতে আসা নাবালিকা। কন্ডোম—‘বেলুন’, আর পুলিশভ্যান— ‘চাক্কা’। উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সুন্দরী এবং হাই প্রোফাইল যৌনকর্মীরা পরিচিত ‘আগ্রাওয়ালি’ বা ‘বেরিয়া’ বলে। কলকাতায় একমাত্র সোনাগাছিতেই এদের দেখা পাওয়া যায়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বইয়ের বিভিন্ন বার এবং অনুষ্ঠানে নাচতে যাওয়া মেয়েদের ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আইডেনটিটি—‘আইটেম’। এই কোড প্রথম মুম্বইয়ে চালু হলেও হালফিল কলকাতায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
কোডের গোপনীয়তায় সবাইকে টেক্কা দিতে পারে হিজড়ে বা বৃহন্নলারা। যা মেইনস্ট্রিম বা সমাজের মূল ধারার কাছে অজানা অচেনা এক শব্দকোষ। এদের ভাষাজগতে বহু শব্দ বা বাক্যের মানে দ্বিমাত্রিক। যেমন— ‘ঝোলকি’ মানে রোজগার বা আয়, ‘থাপ্পু’ মানে টাকা বা নোট। ‘খোবরা’ মানে মাংস। ‘বড় খোবরা’ মানে পাঁঠার মাংস, আর ‘ছোট খোবরা’ মানে মুরগি। ‘আকুয়া’-র অর্থ বহিরঙ্গে পুরুষ কিন্তু হৃদয়ে নারী। ‘ছিবড়ি’— পুরোপুরি পুরুষ কিন্তু জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদে হিজড়ে পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ‘ছিন্নি’ মানে খোজাকরণ। ‘গুরুমা’ বা ‘মুখ হিজড়ে’ কথার অর্থ দলপতি বা গোষ্ঠীপতি। প্রায় প্রত্যেক হিজড়েরই এক অথবা একাধিক পুরুষবন্ধু থাকে। এদের বলা হয় ‘পারিক’, ও ‘ডবল ডেকার’। এরা যথাক্রমে সমকামী ও উভকামী। এ ছাড়াও কমপক্ষে শতাধিক কোড রয়েছে উপরোক্ত দুই জগৎ জুড়ে। ‘সো কলড’ শালীনতার সীমা অতিক্রম করবে তাই সেগুলোর উল্লেখ আর এখানে করলাম না।
চলুন এবার একটু সংখ্যালঘু মহল্লায় চক্কর কেটে আসি। এই সব এলাকার নিজস্ব কিছু কোড আছে যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই বললেই চলে, স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজস্ব ভাষায় গোমাংসের নাম ‘ভক্কর’ বা ‘দো নম্বর’। মোষের মাংস ‘জামসি’। খাসির মাংস ‘এক নম্বর’ আর শুয়োরের মাংস অবশ্যই ‘হারাম’। জবাই করা প্রাণীর মাংসকে বলা হয় ‘হালাল’। অন্যদিকে বলি দেওয়া কোনও প্রাণীর মাংস পরিচিত এবং পরিত্যাজ্য ‘ঝটকা’ আর ‘হারাম’ বলে। খাওয়াদাওয়ার পপুলার কোডনেম ‘জাবরোটি’। বড় বড় কথা বলা বা গুল মারার অভ্যাসকে বলা হয় ‘ফেকফাক’ বা ‘ছোড়মঞ্জন’। অর্থাৎ দাঁতের মাজন বিক্রেতাদের বড় বড় কথায় খদ্দেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাল বিক্রি করার দক্ষতার সঙ্গে উপমাটির মিল টানা হয়। মেয়েলি ধরনের পুরুষ বা হিজড়েদের ‘ছক্কা’ অথবা ‘আট্ঠা’ বলে সম্বোধন করা খুব কমন প্র্যাকটিস এখানে। কিন্তু ফল বিক্রি করা যাদের পেশা তাদের কেন ‘কুঁজড়া’ বলে ডাকা হয় এর কোনও সংগত ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি আজও। এর শেষে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিই আগেভাগেই। সংখ্যালঘু এলাকার রাস্তায় কোথাও মারামারি বাধলে যদি শোনেন কেউ হুঙ্কার ছাড়ছে—‘আবে, লঙ্গি নিকাল…’ সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার চেষ্টা করবেন। কারণ ‘লঙ্গি’ মানে তরোয়াল বের করার কথা বলছে। অতএব সাধু সাবধান।