এ ভাবে কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কোড বা সাংকেতিক ভাষা। যেরকম ‘রামপুরিয়া’ বা ‘কানপুরিয়া’ উত্তরপ্রদেশের দুটো জেলায় তৈরি ছ ইঞ্চি ফলার চাকু। কলকাতায় আগমন ষাটের দশকে। খাপের ভাঁজ থেকে টেনে বা স্প্রিং টিপে খুলতে হত। এদিকে ‘পেটো’ ছাড়াও হাতবোমার একাধিক সাংকেতিক নাম রয়েছে, যেরকম— ‘মাল’ ‘গ্যানা’ অথবা ‘নাড়ু’। বিভিন্ন অস্ত্রের বিভিন্ন কোডনেম। ‘যন্তর’ ‘চেম্বার’, ‘মেশিন’ বা ‘ছোট রড’ আসলে পিস্তল, রিভলবার বা ওয়ানশটার। ‘দানা’ বা ‘ক্যাপসুল’ মানে বুলেট। ‘ন্যাপালা’-র অর্থ ভোজালি বা কুকরি। রাইফেল, মাস্কেট বা বন্দুক যথাক্রমে ‘বড় রড’ বা ‘হনুমান’। গ্রেনেড তো অনেক দেখেছেন হলিউডি বলিউডি সিনেমায়। অপরাধ জগতে এর ছদ্মনাম ‘আতা’। একটু খুঁটিয়ে ভাবুন। আকৃতির অদ্ভুত মিলটা চোখে পড়বে। আশির দশকের গোড়ার সময় থেকে একটি অস্ত্র অপরাধীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষুর— ছোট, হালকা, লুকিয়ে রাখার পক্ষে আদর্শ। কোডনেম ‘আওজার’ বা ‘আস্তুরা’। অস্ত্রের ঝনঝনানি ছেড়ে চলুন এবার একটু অপরাধীদের ডেরায় ঢুকি।
মল্লিকবাজারের মোড়। দু’দল যুবক। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে— ‘হামলোগকা মিস্তিরি বোল রহা থা কি পার্টি মে দো চার লেবার কম পড় রহা হায়। তেলোগকা পার্টি সে আগর কুছ লেবার মিল যায়ে তো বড়ি মেহেরবানি হোগি।’ আপাতদৃষ্টিতে মনেই হতে পারে খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা। একটা শ্রমিকদলে কয়েকজন শ্রমিক কম তাই সেই দলের হেডমিস্তিরি অন্য আরেকটি দলের কাছে ক’জন শ্রমিক ধার চাইছে। আজ্ঞে না মশাই। ব্যাপারটা মোটেই অতটা সোজা নয়। ওরা আসলে দু’দল পকেটমার। এখানে ‘মিস্তিরি’-র অর্থ দলের পান্ডা মানে মূল কাজটা যে করে। অর্থাৎ আমার আপনার পকেট থেকে ট্রামবাসের ভিড়ে মোবাইল বা মানিব্যাগটা তুলে নেয়। এ কাজে ‘মিস্তিরি’-কে যে সাহায্য করে তার কোডনেম ‘সেয়ানা’। এদের কাজ হল ঠাসাঠাসি করে শিকারকে ভিড়ের মধ্যে চেপে ধরা, যাতে সে একদম নড়াচড়া না করতে পারে। দলে সবচেয়ে নিচু পদ ‘লেবার’। গেটের দিকে নজর রাখা এবং যে-কোনও পরিস্থিতিতে দলকে সাহায্য করাটাই এদের ডিউটির মধ্যে পড়ে। পকেটমার জগতে কোড অজস্র। সামান্য কয়েকটি নমুনা দিলাম এখানে।
মানিব্যাগ—‘কালা তাকিয়া’, মোবাইল—‘রোতা বাচ্চা’ (ক্রন্দনরত শিশু), গলার হার—‘ছল্লি’ অথবা ‘পাক্কি’। মহিলা যাত্রী—‘তরকারি’, কাঁচি বা ব্লেড—‘চিপটেন’, কানের দুল— ‘টিংকা’, একশো, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট যথাক্রমে ‘গজ’, ‘গান্ধি’ এবং ‘লালপান’। পুরোটা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং কিছু বিশেষ ধরনের তস্করদের কথা বলি।
হাওড়ায় ট্রেন ধরতে গেছেন। ট্রেন ছাড়তে অনেকটা দেরি হবে। প্রচুর যাত্রী ওয়েটিং রুমে, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত। অনেকেই মেঝেতে চাদর অথবা কাগজ পেতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। আপনিও কিছু একটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন তাদের পাশে। চোখ লেগে এল, ঘুম ভেঙে দেখলেন সঙ্গের লাগেজ উধাও। এটা ‘পড়িবাজ’-এর কীর্তি। ঘুমন্ত যাত্রীর অভিনয় করে নিরীহ যাত্রীর মালপত্র লুটে নিয়ে পালিয়ে যায় এরা। অপরাধ জগতে ঘুমের কোডনাম ‘পড়ি’। সেটা থেকেই ‘পড়িবাজ’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও তিন ধরনের ‘বাজ’-এর সন্ধান মিলবে আমাদের এ শহরে।
‘কটবাজ’-পাতি বাংলায় চিটিংবাজ। বিভিন্ন কায়দায় লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করাটাই এদের একমাত্র পেশা। মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাস, তালতলা, বউবাজার অঞ্চলে এরকম বেশ কয়েকটা বড় বড় ‘কটবাজ’ গ্যাং সক্রিয় ছিল বা আছে। এদের মধ্যে দু’জন তো ভিন রাজ্য থেকে আসা কোনও অবাঙালি ব্যবসায়ীকে নিজস্ব বাংলো বলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর ব্রিগেডকে ধানি জমি দেখিয়ে বেচে দিয়েছিলেন এ রকম প্রবাদ আছে বাজারে।
এবার ‘ঢোলবাজ’। মুটে বা কুলি সেজে ট্রেনের বাঙ্ক থেকে যাত্রীর মাল নামিয়ে দ্রুতপায়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এদের দক্ষতা অপরিসীম।
তবে সেরার সেরা ‘বাজ’ হচ্ছে ‘গাব্বাবাজ’। যে-কোনও ধরনের তালা দু’-এক মিনিটের মধ্যে খুলে বা ভেঙে ফেলা এদের কাছে জলভাত। ক্রাইমের দুনিয়ায় তালার সাংকেতিক কোড ‘গাব্বা’। সেখান থেকে ‘গাব্বাবাজ’-এর উৎপত্তি বলেই মনে হয়। খোলা ছাড়াও নিঃশব্দে যে-কোনও তালা ভেঙে ফেলার ব্যাপারেও এদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাই এদের আর এক নাম ‘গাব্বা ভসকান’। তালা খোলার চাবি একটা সরু লোহার তার। সামনের দিকটা ঈষৎ বাঁকানো। কোডনেম ‘গামছা’। জোর করে ধমকে চমকে টাকা আদায় করার নাম যে ‘তোলা’ বা ‘হপ্তা’ সেটা মিডিয়ার দৌলতে আজকাল অনেকেই জানেন। কিন্তু এর আরও দুটো নাম যে ‘খিরাজ’ বা ‘তোড়িং’ অনেকেই তা জানেন না বোধহয়। লুঠ করা সম্পদের ভাগ বাঁটোয়ারাকে বলা হয় ‘হিস্সা’। এই হিস্সা নিয়ে মামলা অনেক সময় খুনখারাপি পর্যন্ত গড়ায়। যে-কোনও ধরনের অপরাধীর সঙ্গেই যাদের সম্পর্ক অনেকটা ননদ-বউদির মতো তারা হল পুলিশ আর ইনফর্মার। অপরাধ জগৎ এদেরও সাংকেতিক নামকরণ করেছে। পুলিশ—‘মামা’ বা ‘মামু’। আর ইনফর্মার হল গিয়ে ‘খোঁচড়’, ‘টিকটিকি’ বা ‘খবরি’। অপরাধ করেই অকুস্থল থেকে চম্পট দেওয়াই অপরাধীদের মূল লক্ষ্য। ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের ভাষায় এর নাম ‘ঢিল দেওয়া’ ‘নও দো এগারা’ অথবা ‘কালটি’।