একুশ টাকার একটা গুরু কিম্বা গোল্ডেন বিয়ারের বোতল নিয়ে বসে পড়া টেবিলে। তারপর ভেসে যাওয়া সুরসাগরে… এর মধ্যে মণিদা। হাতের সেই অলৌকিক গিটার নিয়ে বেশ কিছুদিন হল পাড়ি জমিয়েছেন অন্য এক গন্ধর্বলোকে। বৃদ্ধ হয়েছেন লু হিল্ট। আরিফভাই ছেলের কাছে, বেঙ্গালুরু। টালিগঞ্জ সিমেট্রিতে চিরশান্তিতে শুয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড। পাম ক্রেন সব ছেড়েছুড়ে অস্ট্রেলিয়া, অনেকদিন হল। ঊষাও সেলিব্রিটি হয়েছেন বহুকাল। পার্ক স্ট্রিটের বার ফ্লোরে এখন শুধু চটুল হিন্দি আর রিমিক্স গান। সব সুরতাল একসাথে ঠেসে দেয়া সিন্থেসাইজার আর অক্টোপ্যাডের জগঝম্প। গলায় সুরের স নেই। শুধু ঠিকঠাক ট্র্যাকে ফেলে গেয়ে দিলেই হল। ভাবতে ভাবতেই ভারী হয়ে যাচ্ছে মনটা। পার্ক স্ট্রিটকে পিছনে ফেলে ডানদিকে ঘুরতেই চৌরঙ্গি রোড। বিশাল চওড়া রাস্তার মাথা ঢেকে গেছে ফ্লাইওভারে। মেট্রোয় ঢোকার সুড়ঙ্গ পথ থেকে মিউজিয়াম অবধি টানা আধো অন্ধকার গা ছমছম পরিবেশ একটা। বাবার কাছে শুনেছিলাম, সন্ধের পর এখানেই কোথাও মাথা নুইয়ে মুখ লুকিয়ে ভিক্ষে করতেন সাধনা বোস। পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত অভিনেত্রী। আলিবাবা ছবির প্রযোজক—অভিনেতা মধু বোসের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর বিপুল ধনসম্পত্তি সব খুইয়ে রাস্তায় এসে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধা। কাছ দিয়ে কেউ গেলে মৃদু করুণ গলায় ভিক্ষে চাইতেন ইংরিজিতে— ভেরি পুওর লেডি… প্লিজ হেল্প মি সামথিং স্যর… মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই মানসপটে ভেসে ওঠা আরেকটা দৃশ্য। আশির দশকের গোড়ার কথা। রাস্তার আলো আরও অনেক কমজোরি ছিল তখন। প্রায়ান্ধকার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন দুই বিগতযৌবনা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্বৈরিণী। মুখে সস্তা লিপস্টিক আর ফেস পাউডারের চড়া প্রলেপ। বয়স ঢাকার ব্যর্থ করুণ প্রচেষ্টা। পাশ দিয়ে গেলেই মিঠে গলায় ডাক, ‘কাম ডিয়ার, কাম উইথ মি, আই প্রমিস ইউ আ ভেরি নাইস টাইম।’ এখন তাদের জায়গা নিয়েছে মালা। হাইট টেনেটুনে চার ফুট দুই কি তিন। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। গাট্টাগোট্টা চেহারা। শাড়ি ঠেলে বেরনো উদ্ধত এক জোড়া বুক। গালে আড়াআড়ি একটা ক্ষুরের দাগ (কোনও বেয়ারা খদ্দেরের কাজ বোধহয়)। মুখে চটুল হাসি। একসময় দ্বি-পেশার পশারিণী ছিল। দুপুর বারোটা থেকে রাত নটা অবধি গ্লোব সিনেমার ব্ল্যাকার। ন’টার পর ফুটপাতে যৌনকর্মী। সাউন্ড অফ মিউজিক, বর্ন ফ্রি-কে সঙ্গে নিয়ে কবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে গ্লোব। তারপর থেকে সন্ধে হলেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পরে মালা। পথচলতি কেউ রাজি হলেই ফুট টপকে সোজা মেট্রো রেলের পাঁচিল আর গাছগাছালির আড়ালে। রেট ইজ ভেরি রিজনেবল। খদ্দের বুঝে মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে আশি টাকার মধ্যে। আলগোছে এসবই দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে এসে পড়া মিউজিয়ামের গেটে। রাতের বেলা যতবারই এই বিশাল দরজার সামনে দিয়ে গেছি, ততবারই একটা অদ্ভুতুড়ে গা-ছমছমে অনুভূতি হয়েছে। অনেকটা ওপরে উঠে যাওয়া চওড়া পাথরের সিঁড়ি। সামনে আলো জ্বললেও নির্জন ভেতরটা। এই বুঝি কফিন ছেড়ে উঠে বেরিয়ে এল ফারাওয়ের মমি বা প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসোরের কঙ্কাল! তড়িঘড়ি জায়গাটা পেরিয়ে এসে সামনে গলির মোড়ে। মিউজিয়ামের শেষ। রাত সাড়ে এগারোটা। হকাররা উধাও। বন্ধ ফুটপাতের চা দোকানগুলো। মিউজিয়ামের রেলিং আর দেওয়াল ঘেঁষে পলিথিনের চাদর বিছিয়ে লাইন দিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকা সার সার বাস্তুহারা পরিবার। চার ইটের উনুনে ভাত তরকারি চড়িয়েছে কেউ কেউ। মুরগির ছাঁট আর গিলেমেটের মনকাড়া ভাপ উঠছে। ওরই মাঝখানে এককোণে গোল হয়ে বসা পাতাখোর পকেটমারের দল। নোংরা শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়। অপুষ্ট ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা। ঝিম খাওয়া চোখ। কাঁপা কাঁপা হাতে ভাগবাটোয়ারা চলছে। পাঁচঠো কালা তাকিয়া (মানিব্যাগ), তিনঠো ‘বাচ্চা’ (মোবাইল),… একঠো ছল্লি (সোনার হার)… কুল মিলাকে… দিনান্তের হিসেব। জড়ানো গলার স্বর আরও জড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এসব একপাশে ফেলে রেখে দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া লিন্ডসের মোড়, টাইগার সিনেমা, থুড়ি শপিং মল পেরিয়ে ফিরপো আর গ্র্যান্ডের ঝুলবারান্দা… দূরে ভিক্টোরিয়া হাউসের ঘড়ি সময় বলছে প্রায় বারোটা। সারাদিন পশারিদের হাঁকডাক আর পথচারীদের ভিড়ে বেজায় সরগরম থাকা জায়গাটা বলতে গেলে প্রায় শুনশান এখন। ইতিউতি ঘুরঘুর করা কয়েকজন কলগার্ল। সামনে এসে দাঁড়ানো প্রাইভেট কার আর ট্যাক্সির অপেক্ষায়। জায়গা আর দরদামে পটলেই দরজা খুলে সোজা সেঁধিয়ে যাওয়া গাড়ির পেটে… ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ধর্মতলার মোড়। মেট্রো সিনেমা। ফের স্মৃতির লাবডুব মনের মধ্যে। সেই মেট্রো। সিঁড়ি থেকে দোতলা অবধি মোড়া লাল কার্পেটে… দেওয়ালে গ্রেগরি পেক, স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জার, অড্রে হেপবার্ন, মেরিলিন মনরো…। দোতলায় উঠেই সামনে লম্বা বার লাউঞ্জ। স্পিকারে টুং টাং পিয়ানোর সুর। দরজার সামনে দাঁড়ানো গেটকিপার দেবুদা। ছ’ফুট সাত কি আট ইঞ্চি। দৈত্যাকৃতি চেহারা। বেয়ারা কোনও দর্শক বেগরবাঁই করলেই ঘাড় চেপে ধরে সোজা হলের বাইরে। পঞ্চাশের দশকে জিঘাংসা নামে একটি থ্রিলার সিনেমায় খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। হলের মধ্যে ঠান্ডা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের আরাম। ডানলোপিলোর গদি আঁটা সিট। গোড়ালি অবধি ডুবে যাওয়া পুরু কার্পেট। শো ‘চালু’ হবার আগে পর্দায় ভেসে ওঠা মেট্রো গোল্ডউইন মায়ারের গোলাকৃতি লোগো। মাঝখানে কেশর ফোলানো সিংহের রাজকীয় গর্জন… সেসব ধুয়েমুছে সাফ কবেই। বহুদিন হল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মেট্রো। মনে আছে হলের সামনে মেট্রো লেখা মিনারাকৃতি চুড়োটার অনুকরণে কানের দুল বানাতেন তখনকার দিনের মা-কাকিমারা, ভাবলেই ভারী হয়ে আসে মনটা।