রাত সাড়ে ন’টা। হোটেল বন্ধ হওয়ার মুখে মুখে তড়িঘড়ি খেতে ঢুকছেন রোজকার বাঁধা খদ্দেররা। আপাতত নিজের ঢোকার কোনও প্রশ্নই নেই। তাই ফের টাপলা খেতে খেতে হাঁটা শুরু সামনে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে। ফায়ার ব্রিগেডের গায়ে হবনার। শাটার বন্ধ হচ্ছে দ্রুত। শো-কেসে সাজানো গিটার, কি-বোর্ড, সিন্থেসাইজার, জ্যাজড্রাম আর সেই বিশাল স্যাক্সোফোন। জীবনে ছেলেবেলায় রথের মেলায় কেনা ভেঁপু বাঁশি ছাড়া আর কোনও কিছুতে ফুঁ দিয়ে দেখিনি কোনও দিন। কিন্তু রাতে কতবার যে স্বপ্ন দেখেছি, চোখের সামনে হাট হয়ে খুলে যাচ্ছে হবনারের শো-কেস। তিসরি মঞ্জিলের শাম্মি কাপুরের মতো দু’পা ফাঁক করে স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আমি… গলায় রফি সাহেব… ইয়ে দুনিয়া উসিকি, জমানা উসিকা… হাতের মুঠোয় ধরা স্যাক্সোয় সেই সাপ খেলানো সুর… হবনারের উল্টোফুটে সার সার ইংলিশ পেপার ব্যাক আর পুরনো রেকর্ডের দোকান। যতবার চোখে পড়ে ততবারই হড়কা বানের মতো বুকের মধ্যে লাফ দিয়ে নামা একঝাঁক স্মৃতি… এখান থেকেই দরদাম করে কিনে ফেলা কত সেকেন্ড হ্যান্ড লং প্লেয়িং রেকর্ড আর পেপারব্যাক… লুই আর্মস্ট্রং, বিং ক্রসবি, নীল ডায়মন্ড, ভেঞ্চারস, উডি গাথারি, কেনি জি, বিটলস্… হেমিংওয়ের ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ আর জ্যাক লন্ডনের ‘হোয়াইট ফ্যাং’… তারপর গুটি গুটি পায়ে দল বেঁধে ঢুকে পড়া সদর স্ট্রিটে। সেটা সত্তরের শেষ ভাগ। ছেঁড়া জামাকাপড়, জটপড়া চুল আর বাউলঝোলা কাঁধে হিপিরা তখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি শহর থেকে। ইতিউতি বসে থাকা ফুটপাতে এখানে ওখানে… একই কল্কেয় গাঁজায় টান রিক্সাওয়ালার সঙ্গে… ছিলিম থেকে লাফ দিয়ে ওঠা আগুনের হল্কা… শহরের বুকে লালন খ্যাপার আখড়া যেন। শিকাগো থেকে সদর স্ট্রিট… সুর মিলে মিশে একাকার কলকাতায়। তখন সদর স্ট্রিট শাসন করত কাইয়ুম। বেঁটে খাটো চেহারা। লুঙ্গির গেঁজে চরসের পুরিয়া। সদ্য আমদানি হয়েছে কলকাতায়। চটচটে পিচের ড্যালার মতো ছোট্ট একটা গুলি। আগুনে সেঁকে নিয়ে গুঁড়িয়ে চালান করে দেয়া সিগারেটের রিফারে অথবা কল্কেয়। বাকিটা রূপকথা। সব স্বপ্নই যেখানে জীবন্ত… ঝিমঝিম অতীত আর স্বপ্নের চটকাটা কাটিয়ে আবার ফিরে আসা বাস্তবের জমিতে। এসে দাঁড়িয়ে পড়া ফ্রি স্কুল স্ট্রিট আর মার্কুইস স্ট্রিটের মোড়ে। হাতের ডানদিকে ছিল যমুনা সিনেমা। ছিল মানে এখন আর নেই। মাল্টিপ্লেক্স, সিডি, ডিভিডি, পেনড্রাইভ আর ডাউনলোডের যৌথ গুঁতোয় অনেকদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে শহর থেকে। এখানেই সিঙ্গল স্ক্রিনে দেখা স্টিফেন স্পিলবার্গের ‘জস’, জোসেফ লেভিনের ‘সোলজার ব্লু… অবিস্মরণীয় সব ছায়াছবি। এখন সেখানে একটা হোটেল জাতীয় কিছু। ঝকঝকে কংক্রিটের খাঁচা। কোনও জানলা নেই (অন্তত চোখে পড়ছে না)। খোপে খোপে শুধু এসি মেশিন। দেখলেই দম আটকে আসে কীরকম একটা। এই রে! আবার সেই স্মৃতির চক্করে। তবে বেশ বুঝতে পারছি, এরকমটাই চলবে আজ সারারাত। অতীত আর বর্তমানের মধ্যে অবাধ বিচরণ। বারবার। কিন্তু সারারাত কেন? উত্তরটা তো ভারী সোজা। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না যে। পেত্নীজলার চোরাপাঁকে কুহকিনী আলেয়ার মতো আমায় টানছে রাত কলকাতার ফুটপাত।
রাত সাড়ে দশটা। সামান্য এগোতেই ‘হাউ হুয়া’। কলকাতায় সবচেয়ে পুরনো চিনে রেস্তোঁরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। একমাত্র এখানেই পাওয়া যেত সেই দুই অমৃত পদ। চিমনি ডাক স্যুপ আর রোস্টেড পিপিং ডাক। যমুনার মতো হাউ হুয়াও অতীত এখন। ঠিক একই ভাবে অতীত মোড়ের উল্টোদিকে খালিকুঠিটা। খালিকুঠি। গোপন মধুচক্র। হলুদ রঙের দেওয়াল আর সবুজ রঙের দরজা জানালা। এ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বাড়ির ওটাই সিম্বল। দালালদের সহায়তা ছাড়া ঢোকা যেত না ওইসব বাড়িগুলোয়। সন্ধে হলেই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে খালিকুঠির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ত দালালরা। রসিক খদ্দের বুঝলেই লেগে যেত পিছনে ‘কলেজ গার্ল স্যর… একদম কচি চিজ…।’ সেসব পাট চুকেবুকে গেছে অনেকদিন। প্রত্যেকটা খালিকুঠিই এখন কলকাতায় শপিং আর ট্রিটমেন্ট করতে আসা বাংলাদেশিদের থাকার হোটেল। সাময়িক মাথা গোঁজার আস্তানা। খালিকুঠির উল্টোফুটে সস্তা মুসলমান ঢুলিয়া হোটেল। যাক। এটা অন্তত উঠে যায়নি এখনও। এত রাতেও হোটেলের সামনে লম্বাটে চৌকোনা মাটির উনুনে সেঁকা হচ্ছে শিক কাবাব। অবশ্যই বিফ। মুচমুচে পরতওয়ালা, ডালডায় ভাজা পরোটার মধ্যে ভরে এক টুকরো কাগজে মুড়ে দেওয়া। সামান্য ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ আর কাগজের ফাঁকে গোঁজা একটা কাঁচা লঙ্কা। সসফস জাতীয় এক্সট্রা কোনও চালিয়াতি নেই। দাম ? মাত্র বারো টাকা। ভাবা যায়! গোমাংসে আপত্তি না থাকলে ট্রাই করে দেখতে পারেন। স্বাদে বালিগঞ্জ গড়িয়াহাটের অভিজাত রোল বিপণিগুলোকে বলে বলে দশ গোল মারবে যে-কোনওদিন। কিনে খেতে খেতে ফের হাঁটা পার্ক স্ট্রিটের দিকে। পাঁইটের নেশাটা ফিকে হয়ে আসছে একটু একটু করে। কুছ পরোয়া নেহি। অন্য নেশা লেগে গেছে এতক্ষণে। রাত কলকাতার ফুটপাত হপিংয়ের নেশা।
রোল আর টাল দুটোই একসঙ্গে খেতে খেতে পার্ক স্ট্রিটের মোড়। হাতের বাঁদিকে ‘স্কাই রুম’। একসময় কলকাতায় সেরা বিদেশি খাবারের ঠিকানা। এদের দেবভোগ্য এক্লেয়ার স্যুপ। ষাটের দশকে দুনিয়া কাঁপানো অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো কলকাতায় এলে এখানেই তাঁকে খাওয়াতে এনেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। সেই স্কাই রুমও এখন অতীতের তালিকায়। টিকে আছে ‘অলিপাব’ আর ‘মোকাম্বো’। সুরা আর বিফস্টেকের জন্য নাম শহর জোড়া। রাস্তার ঝলমলে আলো, বাচ্চা বাচ্চা বেলুনওয়ালা ছেলে মেয়ে, ছেঁড়া ফ্রক আর জামা, সিগন্যালে গাড়ি থামলেই দৌড়ে যাচ্ছে। স্ট্রবেরি আর ফুলের পসরা নিয়ে রোগা রোগা চেহারার নারীপুরুষ। আইসক্রিমের গাড়ি ম্যাগাজিনের স্টল, বাড়তি ভাড়ার প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষমাণ ট্যাক্সি ড্রাইভার, ফ্লুরিজের বিশাল কাচ, পার্ক হোটেলের গায়ে ছোট দোকানটায় বরফের ওপর রাখা পান, পাশে তাকে সার দিয়ে সাজানো দেশি-বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট, অক্সফোর্ড বুক স্টোর, এসব ঠিকই আছে, কিন্তু হারিয়ে গেছে ব্লু ফক্স। মাথার ওপর নীল নিয়নের সেই মুখ ঘোরানো শেয়াল। সেখানে এখন ভাজা মুরগির দোকান না কী একটা হয়েছে যেন। নেই পিপিং-ও। পুরনো কলকাতায় চাইনিজ কুইজিনের আরেক সেরা ঠিকানা। পার্ক হোটেলের গায়ে ট্রিংকাস। ট্রিংকাস আর ব্লু ফক্স। সত্তর-আশির দশকে এখানেই গাইতেন পাম ক্রেন, ঊষা আয়ার (উত্থুপ হননি তখনও)। গিটার, স্যাক্সো, পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান আর জ্যাজড্রামে ঝড় তুলতেন মণিদা (মহীনের ঘোড়ার গৌতম চাটুজ্যে), লু হিল্ট, ডোনাল্ড বিশ্বাস, আরিফভাই, নন্দন বাগচী… সরস্বতীর পুত্রকন্যা সব।