আঙ্গুরিদি। ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি। মলিন, নোংরা। কঙ্কালসার চেহারা। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ থেকে গড়িয়ে নামা জল শুকিয়ে গেছে কবেই। নির্বাক, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনে। আঙ্গুরিদিকে যতবার দেখি ততবারই মাথার মধ্যে গিটারের টুংটাং আর গুনগুনিয়ে ওঠা দুখজাগানিয়া সেই ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর—
সময় দেখবি সব ভোলায় দুলিয়ে
আনকোরা রঙগুলো বুলিয়ে বুলিয়ে
মেলায় কাটার দাগ, জোড়া লাগে ফাটা
জটিলতা হয়ে যায় খুব সাদামাটা।
তোর বুঝি উড়ে গেছে খাঁচাখোলা পাখি
উড়ে গেছে হৃদয়ের আকাশে অপার
সময়ে দেখবি সব জোড়া লেগে যাবে
চুপ কর বোকা মেয়ে, কাঁদিসনে আর।
১৯. সারারাত ফুটপাত
রাত সাড়ে আটটা। ভিড়ে ঠাসা বারদুয়ারির দোতলা। সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়া, চাট আর অ্যালকোহলের পাঁচমিশেলি গন্ধে ভারী হয়ে আছে ঘরটা। পচা ঘেমো ভ্যাপসাটে গরম। সার সার ফাটা ফাটা পুরনো লম্বাটে কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপর শালপাতায় বিটনুন মাখা ছাল ছাড়ানো বাতাবিলেবু আর চানা মিক্সচারের ধ্বংসাবশেষের পাশে সেই সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাংলার পাঁইট। তলায় ইঞ্চিটাক গভীর মদিরার তলানি। ‘এবার উঠতে হবে’ হাঁক পেড়ে ঘুরে যাচ্ছে কর্মচারীরা। অতএব গেলাসে ঢেলে জল মিশিয়ে একচুমুকে তলানিটুকু শেষ করা। হাল্কা টাল খেয়ে উঠে দাঁড়ানো টেবিল ছেড়ে। কর্পোরেশনের কেরানি, শেয়ার মার্কেটের খুচরো দালাল, হাফচিটিংবাজ ফোতো বাবু, ফ্রাস্টেটেড কবি, মেঝেয় বসে শুধু বিটনুন দিয়ে চাট করা রিকশাওয়ালা সবাই যে যার আস্তানায় ফিরতে ব্যস্ত। একতলায় নামবার সিঁড়িটার মুখে বেজায় জটলা। সবাই একসাথে নামতে চায়। ফলে হই হল্লা, ঠ্যালাঠেলি, খেস্তাখেস্তি… ঠেলেঠুলে নেমে আসা একতলায়। কাউন্টারে বোতল ফেরত দেবার ভিড়। পাঁইট ফেরত দিয়ে পাওয়া দু টাকার নোট আর এক টাকার কয়েন। ডিপোজিট মানি। বাইরে বেরোনোর গেটের মুখেই সামনে টেবিলটায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বউমরা হারুদা। বছর ষাটেক। বাড়ি তালতলায়। রফি সাহেবের ডাই-হার্ড ফ্যান। একটু চড়ে গেলেই করুণ গলায়, ‘শুকনো ফুলের মালার মতো’ এই অবধি গেয়েই ঠকাস করে মাথা ঠুকে পড়ে যান টেবিলে। পরের কথাগুলো কমপ্লিট করতে শুনিনি কোনও দিন। এই মুহূর্তে মিডলস্ট্যাম্প ছিটকে ক্লিন বোল্ড আউট। কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে বুধো। বারদুয়ারির অল পারপাস জব পারসোনেল। খদ্দেরদের চাট-গুটখা-সিগারেট এনে দেয়। আপাতত বেশ খানিকটা বিরক্ত চোখমুখের চেহারা। সেটা ফুটেও বেরোচ্ছে গলায়, ‘ও হারুদা, কী হল কী? দোকান বন্ধ হবে… ওঠো না। ধুর বাঁড়া! এইসব মাতালমারানি শুঢঢাদের নিয়ে হয়েছে যত শালা ঝামেলা…’
অতঃপর হে মহামহিম পাঠককুল, আপাতত এইসব অবিস্মরণীয় এবং মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট আর বাক্যবন্ধকে পিছনে সরিয়ে রেখে আসুন, ফুটপাতে নামা যাক। ডাইনে ঘুরেই বারদুয়ারির হলুদ দেওয়ালের গায়ে ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলোয় ফুটপাতে মিশির ভাইয়ের লিট্টি বিপণি। সম্বল বলতে একটা ছোট মাটির উনুন। উনুনের ওপর লোহার তাওয়া। পাশে বড় বড় দুটো বাটিতে আটা মাখা আর কাঁচা লঙ্কার কুচি মেশানো ছাতুর পুর। কাঠের বেলন-চাকি। ছোট ছোট করে লেচি বেলে নিয়ে মাঝখানে একটু ছাতুর পুর। গোল গোল করে পাকিয়ে সেঁকে নেয় উনুনের আঁচে। সঙ্গে মাখা মাখা সেদ্ধ আলুর চোখা আর রসুন কাঁচালঙ্কার চাটনি। শীতকালে সস্তাগন্ডার বাজারে আলুর সঙ্গে বেগুন আর টমাটোও থাকে। চাটনিতে যোগ হয় ধনে পাতা, কালেভদ্রে পুদিনা। বারদুয়ারি থেকে বেরিয়ে মিশির ভাইয়ের দুটো লিট্টি। ইংরেজিতে যাকে বলে গিয়ে — মাস্ট। উল্টোফুটেই হামিদ চাচার পুরনো বই আর ম্যাগাজিনের দোকান। বাপের আমলের। শুনেছি এই দোকান থেকেই নাকি খুঁজে খুঁজে পুরনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিনতেন বিভূতিভূষণ। গোগ্রাসে গিলতেন সংখ্যাগুলো। জীবনে কোনওদিন আফ্রিকা যাননি। শুধুমাত্র পড়েই লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একখানা ‘চাঁদের পাহাড়’। ‘আমি জীবনে অনেকবার আফ্রিকা গেছি। হয়তো আরও যাব। কিন্তু হাজারবার গিয়েও আমার পক্ষে একটা চাঁদের পাহাড় লেখা সম্ভব নয় ।’ বলেছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। ঠিক একই ভাবে এই দোকানেই ছেঁড়াফাটা, ডাঁই করে রাখা স্টারডাস্ট, ফিল্মফেয়ার, ডেবনিয়ার আর স্পোর্টসউইকের পাঁজা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাই একদিন ১৯৭০-এর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডায়ান ফসি সংখ্যাটা পেয়ে গেছিল এই অধম প্রতিবেদকও। ডায়ান ফসি। বছর পঁচিশের উজ্জ্বল তরুণী। জীববিজ্ঞানের গবেষক আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধনী দেশে গবেষণা করে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি জীবনটা। তা না করে চলে গেলেন কঙ্গো রেইন ফরেস্টের গহিন অরণ্যে। সেখানকার বিলুপ্তপ্রায় মাউন্টেন গোরিলাদের বাঁচানোর জন্য। বহু কায়েমি স্বার্থে ঘা পড়ল। শেষমেশ খুন হয়ে গেলেন চোরাশিকারিদের হাতে। সংখ্যাটা আজও যত্ন করে বাঁধানো আছে বইয়ের তাকে।
এই দেখুন, লিখতে বসলাম ফুটপাথ নিয়ে, এসে পড়লেন বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহ, ডায়ান ফাসি। উঁকি মেরে গেল চাঁদের পাহাড়, কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট। কী মুশকিল! যাক গে, এসব স্মৃতির কচকচানি হটিয়ে চলুন হাঁটা লাগানো যাক দক্ষিণমুখো। ডানফুটে লোহালক্কর, পার্টস আর বাঁ ফুটে সস্তা লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি-পাজামার ছোট ছোট দোকানগুলো পেরিয়ে জানবাজার মোড়। ফটো বাঁধাইয়ের স্টল, ফলপট্টি, সুপুরিপট্টি, মুদিখানা আর পাখির খাবারের দোকানগুলো শেষ হলেই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। কলকাতায় আদি বাঙ্গালি খানার হাতে গোনা শেষ কয়েকটি হোটেলের মধ্যে একটি। রানি রাসমণির বাড়ির গায়ে। মাছের মুড়োর মুগডাল, মুড়িঘণ্ট, ঝুরো ঝুরো আলুভাজা, শুক্তো, পাকাপোনার কালিয়া, গরমের সময় শেষ পাতে তিন ফালি করে কাটা সুপক্ক হিমসাগর আম। খেয়ে বেরনোর পর মনে হবে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানেই। ফারাক শুধু কাশ্মীরের জায়গায় জানবাজার।