আর এদিকে প্রতিমাদি। স্বপ্নভঙ্গের পরেও স্বপ্ন দেখে চলেছেন। “বাপিডার বিয়া দিমু। বৌমা আইবো। নাতিপুতি হইবো। আমারে ডাকবো—‘ঠাম্মা, ঠাম্মা,’ ঘরে চিল্লাচিল্লি, দুষ্টামি… হেইসব না হইলে হয়? আপনেই কয়েন। ও দাদা, একডু বোঝান না পোলাডারে। হ্যায় তো ঘাড়ই পাতে না। ঘেঁটি শক্ত কইরা থাকে। কয় ‘ওসব হইবোখান।’ আপনে দ্যাহেন না একডু। যদি…।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা সবাই জীবনে কখনও না কখনও, কোথাও না কোথাও অন্তত একবারের জন্য হলেও প্রতিমাদিদের দেখা পেয়েছেন। না পেলেও হতাশ হবেন না কারণ প্রতিমাদিরা সর্বত্র বিরাজমান। শুধু চোখকান খোলা রেখে খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা।
“দ্যাকো বাপু, রোজ গন্ডা গন্ডা মানুষ চড়িয়ে খাই। তোমার কতবাত্তা শুনলে বোঝা যায় তুমি ঠিক আর পাঁচজনের মতো নও।” নীলমণি মিত্র লেনে প্রজেক্ট সোনাগাছির অফিসে বসে কথাটা আমার উদ্দেশে ছুড়ে দিলেন মিনুদি। কথাটা আগেও দু’-চারবার বলেছেন, গুরুত্ব দিইনি তেমন। এবার আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “তা হলে কার মতো মিনুদি?” চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে দেখে নিলেন মিনুদি। একসময় সোনাগাছি কাঁপানো ডাকসাইটে সুন্দরী। যৌবন থাকতে থাকতেই ভালমতন গুছিয়েগাছিয়ে নিয়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ষাট টপকেছেন বছর পাঁচেক হল। বর্তমানে সংস্থায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো ভালবেসেই কাজটা করেন। দুপুরবেলার কর্মব্যস্ত প্রজেক্ট অফিস। লোকজনের আনাগোনা। আমার প্রশ্নের জবাবে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, “সে একেনে নয়, আমার ফেলাটে এসো একদিন। সব বলবোখন।” কথাকটা বলেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন মিনুদি। আমার কৌতূহলটা বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
দিনতিনেক বাদে অফিসের কাজ সেরে পৌঁছে গেছিলাম অবিনাশ কবিরাজ রোয়ে মিনুদির ফ্ল্যাটে। সচ্ছলতার ছাপ গোটা ঘর জুড়ে। “বসো” সামনে সোফাটার দিকে আঙুল দেখালেন মিনুদি। “এবার বলো, আমি কার মতো।” বাঁধভাঙা কৌতূহল প্রশ্ন হয়ে উঠে এল আমার গলায়।
বলেছিলেন মিনুদি। সে অনেক, অনেককালের কথা। একাত্তর সাল। শ্রাবণ মাস। ঘোর বর্ষা। বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে অবিনাশ কবিরাজ রো, দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট, ইমামবক্স লেন… গোটা সোনাগাছি। সেই দুর্যোগের রাতে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ। গোটা চত্বর জুড়ে সার্চলাইটের আলো, হাঁকডাক আর ভারী বুটের দাপাদাপি। ঠিক তখনই বন্ধ ঘরের দরজায় ‘খুট, খুট’। দরজা খুলেছিলেন সন্ত্রস্ত মিনুদি। না, পুলিশ নয়। অন্য একজন। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। একগাল দাড়ি। বড় বড় দুটো চোখ। মিনুদিরই বয়েসি। পরনের পাঞ্জাবি-পাজামা ভিজে চুপচুপে। কাঁধে ঝোলাব্যাগ। দৌড়জনিত পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে বেদম। হাপরের মতো ওঠানামা করছে রোগা রোগা বুকের খাঁচাটা। যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন মিনুদি। হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন ছেলেটাকে। সোজা খাটের তলাটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, “চুপচাপ ঢুকে যাও। নীচে!”
গোটা এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ব্যর্থমনোরথ পুলিশবাহিনী ফিরে যাবার পরও দিন-তিনেক মিনুদির ঘরে থেকে গেছিল ছেলেটা। যাবার দিন দরজায় পা দেবার মুখে জিজ্ঞেস করেছিল মিনুদি— “চ্যায়রা দেকলেই বোঝা যায় নেকাপড়া জানা ভদ্দরনোকের ছেলে। এতিপেতি গুন্ডাবদমাশ নও। জেনেবুঝে এরকম খতরনাক লাইনে এয়চো ক্যানো? কে তোমাদের ম্যাস্টার? কোন আবাগীর ব্যাটা মাতা খারাপ কোচ্চে তোমাদের?” জবাবে মিষ্টি হেসে কাঁধের ঝোলাটা থেকে একটা কাগজের কাটিং বের করে মিনুদির হাতে দিয়েছিল ছেলেটা। একটা ছবি। ছবির ওপর আঙুল দেখিয়ে বলেছিল—“ইনি। তোমার কাছে রেখে দাও এটা।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেছিল ঘর ছেড়ে।
“সেই মাস্টারের ছবিটা দেকবে ভাই?” বলতে বলতে খাটের তলায় ঝুঁকে পড়েছিলেন মিনুদি। টেনে বের করে এনেছিলেন একটা পুরনো তোরঙ্গ। পাট করে রাখা শাড়ির ভাঁজে বিবর্ণ, মলিন, হলুদ হয়ে যাওয়া পেপার কাটিং। একটা ফটো। শীর্ণকায় ছোটখাটো চেহারা। চোয়াল বসা হাসি মুখ। মোটা ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল একজোড়া চোখ, তলায় ক্যাপশন— ‘শোককে ক্রোধ আর ক্রোধকে ঘৃণায় পরিণত করুন!’
“শুনেচিলুম শুয়োরের বাচ্চারা হাসপাতালে মেরে ফেলেচিল ওনাকে… অ্যাতোগুলো বছর কেটে গ্যালো ভাই। অ্যাকোনো মাঝেমধ্যেই রাতবিরেতে ধড়ফড় করে উঠে বসি বিছানায়। ওই বুঝি সে দরজায় কড়া নাড়লো…।” খাটে বসা মিনুদি। মাথা নিচু। থরথর কাঁপছে শরীরটা। এ বড় জটিল, কঠিন সময়। শোক সামলানোর। মিনুদিকে দিতে হবে সেটা। আর একটিও কথা না বলে বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে।
রবীন্দ্র সরণী যেখানটায় সোনাগাছি লেনে বাঁক নিয়েছে ঠিক তার মুখে দেয়ালে হেলান দিয়ে পাথরের মতো মুখে বসে আছেন আঙ্গুরিদি। আঙ্গুরি বেগম। রোজই থাকেন। সেই কোন ছেলেবেলায় উত্তর চব্বিশ পরগনার অজগ্রাম থেকে পাচার হয়ে এসে ঢুকে পড়েছিলেন ইমাম বক্স লেনের গলিতে। আর বেরোনো হয়নি। যৌবন শুষে নিয়ে চলে গেছে খদ্দের। বুড়ো বয়সে এলাকার বেশির ভাগ যৌনকর্মীর যে পরিণতি, তাই বর্তেছিল আঙ্গুরিদির কপালে। জোয়ান মেয়েদের ঘরে আসা কাস্টমারদের মদ-সিগারেট-চানাচুর-চাট এনে দিয়ে হাতে যা বাঁচত, তিল তিল করে জমানো সেই টাকায় রাস্তার ধারে চায়ের দোকান দিয়েছিলেন একটা। দোকানটা চালাতেন আঙ্গুরিদির বাবু। একদিন ভোরে উঠে দেখেছিলেন সমস্ত পুঁজিপাটা নিয়ে বাবু হাওয়া। আঙ্গুরিদির বুকফাটা আর্তনাদে দু’রাত্তির আশপাশের পাঁচ-দশটা বাড়ির মেয়েরা দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।