আজকাল বিস্ময়ভরে একটা ব্যাপার খেয়াল করছি। মেটিয়াবুরুজে হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ এবং সমাজবিরোধীর গুলিতে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনায় রোজ উঠে আসছে একের পর এক নাম। তাদের সঙ্গে অপরাধ, অপরাধ জগৎ আর রাজনীতির উচ্চতম মহলের যোগাযোগের কথা। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করছেন বিরোধী (পূর্বতন শাসক) দলের নেতারা। যেন মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ এলাকা এই সেদিন অবধিও স্বর্গরাজ্য ছিল! রাতারাতি ব্রাজিল-কলম্বিয়ার অলিগলি, নিউ ইয়র্কের ডাউন টাউন বা মুম্বইয়ের ধারাভি ডোংরির মতো অপরাধের নরকে পরিণত হয়েছে। অথচ বন্দর এলাকায় মাফিয়াচক্রের কাহিনি তো আজকের নয়। স্মাগলিং, ভাঙা জাহাজের অকশন, কাটা কাপড়ের ধান্দা, ড্রাগ পাচার থেকে হালফিলের বেআইনি নির্মাণের ইতিহাস তো প্রায় চার দশকের পুরনো। বন্দর এলাকার দখল নিয়ে গ্যাংওয়ার, এনকাউন্টার আর মৃত্যু। অপরাধ জগতের গ্রাফটা নীচে নামেনি কখনওই। উলটে রাজনৈতিক রং পালটে পালটে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে বাহুবলীরা। অথচ আলোচনার সময় এ সব কথা বেবাক ভুলে যান এইসব নেতারা। এরা ভুলে যান চুরাশি সালে এই মেটিয়াবুরুজেই বাতিকল কাচ্চিসড়ক এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল সৎ এবং সাহসী পুলিশ অফিসার ডি সি পোর্ট বিনোদ মেহতাকে। এই কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত ইদ্রিস মিঞার মৃত্যু হয় পুলিশি হেফাজতে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক সংবাদপত্রে বারবার নাম উঠে আসে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতা ও মন্ত্রীর। যথারীতি নমো নমো করে একটা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। ফল? খুদা মালুম। আলোচনার সময় এসব কথা বেমালুম ভুলে মেরে দেন ওইসব নেতারা। এরা ভুলে যান অনিতা দেওয়ানের কথা। বর্বরভাবে ধর্ষণ এবং খুন করেও ক্রোধ মেটেনি জানোয়ারদের। ময়নাতদন্তের সময় জননাঙ্গের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল প্রমাণ সাইজের একটা টর্চ। ক্ষমা করে দেবেন অনিতা দেওয়ান। সেই বিস্মৃতির তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বিজন সেতু আনন্দমার্গী হত্যা। কারা জড়িত ছিল? এই কেসে তদন্তকারী অফিসার তিলজলা থানার ওসি গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের বুকে কে বা কারা মোটর সাইকেল করে এসে গেঁথে দিয়েছিল একের পর এক বুলেট। তদন্ত রিপোর্ট বলছে বুলেটগুলো ছোঁড়া হয়েছিল নাইন এমএম পিস্তল থেকে। ঘাতক অথবা ঘাতকবাহিনীকে কিন্তু ধরা যায়নি কোনওদিনই। ভাববার কথা। ভাবতে হবে। ডান-বাম-লাল-গেরুয়া-তেরঙ্গা সবাইকে। আগের সেদিন আর নেই যে, রাজনীতিকদের অঙ্গুলিহেলনে মস্তানচক্র নিয়ন্ত্রিত হবে। ক্ষমতায় থাকলে সবকিছু চেপে দেওয়া আর ক্ষমতাচ্যুত হলে চেপে যাওয়া আর ভুলে যাওয়া— এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে তাহলে সেদিন আর দূরে নয় যখন রাজনীতি গুন্ডাদের নয় উলটে গুন্ডারাই জার্সি পালটে পালটে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শেষের সেদিন সত্যিই ভয়ংকর! তবু কোথায় যেন ক্ষীণ আলোর একটা রেখা। সিলভারলাইন ভাঙড়, গার্ডেনরিচ কাণ্ডে একাধিক গ্রেফতারির ঘটনায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেটা (দুর্ভাগ্যবশত নন্দীগ্রাম, কেশপুর, আরামবাগ, খানাকুল, নেতাই, গোঘাট, দাসের বাঁধে সেটা দেখতে পাইনি আমরা)। মিলিয়ে না যায়। তা হলেই অন্য একটা কালো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গায়ে আর এক পোঁচ কালো রং লেগে যাবে। লাগতেই থাকবে। বারবার। হাজার প্যাকেট প্রশাসনিক ডিটারজেন্টেও উঠবে না সে রং। অতএব সময় থাকতে, সাধু সাবধান!
০২. কোড কলকাতা
সেটা সত্তরের দশক। টালমাটাল অস্থির সময়। সন্ধে আটটা নাগাদ দুটো ছেলে। গায়ে আলোয়ান জড়ানো, কলেজ স্কোয়্যারের গা ঘেঁষে সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে এগোচ্ছিল নিচু গলায় কথা বলতে বলতে— ‘লালের স্টক কী রকম?’
‘তা মোটামুটি ভালই’, ‘আর সাদা-র কী খবর?’ ‘সমর তো বলল কালকের মধ্যে সাপ্লাই এসে যাবে।’ ‘তা হলে তো আর চিন্তা নেই, এত পেটো ঝাড়ব যে মাকুরা পুরো এলাকা থেকে সাফ হয়ে যাবে।’
পাঠকবর্গ, এইটুকু বলার পর যদি হেড এগজামিনারের ভাষায় প্রশ্ন করা যায়— ‘উপরোক্ত বাক্যগুলির ভাবার্থ বর্ণনা করো…।’ কী হল? হযবরল-র কাকেশ্বর কুচকুচের মতো হাতে পেনসিল হয়ে গেছে তো? আরে না না, ইয়ার্কি মারছি না একদম, আসলে ওপরের রহস্যময় কথোপকথনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কয়েকটি ছোট্ট শব্দ— ‘কোড’। আসুন আর হেঁয়ালি না করে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি।
প্রথম জন ‘লাল’ এর স্টক জিজ্ঞেস করছে। ‘লাল’ মানে পটাশ। এক ধরনের রাসায়নিক। ‘সাদা’-র অর্থ ম্যাগনেশিয়াম মোমছাল। সেটাও রাসায়নিক। আর এক ধরনের। দুটো রাসায়নিকের ভূমিকাই ‘পেটো’ অর্থাৎ হাতবোমা বাঁধার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই দু’জন যুবক নকশালপন্থী। ‘মাকু’ মানে ওদের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুদলের সংক্ষিপ্ত কোডনেম। ওই রাজনৈতিক দলটির সমর্থকরাও নকশালপন্থীদের ‘নকু’ কোডনামে ডাকত।
কোনও রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা মতবাদকে হেয় বা খাটো করার ন্যূনতম প্রয়াস এই প্রতিবেদকের নেই। আসলে সেই সময় কলকাতা তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে কোড বা সাংকেতিক ভাষাগুলো রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রচলিত ছিল তার একটা নিরপেক্ষ এবং নির্ভেজাল বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি মাত্র। যাই হোক, বহু প্রাণ এবং ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে সত্তর দশক তো বিদায় নিল, কিন্তু পরবর্তীতে কোডগুলো ছড়িয়ে পড়ল অপরাধজগতে। এর মধ্যে ‘মাকু’ আর ‘নকু’ আজকাল আর তেমন শোনা না গেলেও ‘লাল’ ‘সাদা’ আর পেটো কিন্তু স্বমহিমায় বিরাজ করছে আজও।