রামবাগানের ভীষণ পুরনো বাড়িটার ছাদ। ছাদে শুকিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়া গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে বসা বুড়িদি। বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। সামনে রাখা ওল্ড মঙ্কের আধখালি গেলাস। প্লেটে চানাচুর, শশা, পেঁয়াজ। বুড়িদিকে ঘিরে গোল হয়ে বসা আমরা দু’-চারজন। আধখাওয়া গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছোট একটা চুমুক দিল বুড়িদি। ফের শুরু করল— “কিন্তু আপশোস একটাই, বুইলি। এই যে মিনসেগুলো অ্যাতোবার আমাদের ঘরে এলো, বসলো কিন্তু এই গোটা রামবাগান-সোনাগাছি…কোনও আঁটকুড়ির পেটে একটা বাচ্চা দিয়ে গ্যালো না!” হতাশা ঝরে পড়ল বুড়িদির গলায়।
আমি। যৌনকর্মীদের নিজস্ব একটি সামাজিক সংগঠনের ‘অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং’ অর্থাৎ পাচার বিরোধী প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর। কিছুদিন হল জয়েন করেছি। এলাকার ঘাঁতঘোঁত জানি না ভাল করে, তার ওপর বহিরাগতও বটে। ফস করে একটা আনকা প্রশ্ন করে বসলাম, ‘আচ্ছা বুড়িদি, এই নেঙড়োরা কারা?” একে তো পেটে বড় বড় তিনটে পাটিয়ালা পেগ। তার ওপর এরকম নির্বোধের মতো প্রশ্ন। ভয়ংকর বিরক্তি আর হতাশা মেশানো চোখে আমার দিকে তাকালেন, যার একটাই মানে হতে পারে— এটা কে রে? তারপর গলায় বিরক্তিটা ঝরে পড়ল—“আরে মুখ্যু, এটা বুইলিনি? সেই যে যুদ্ধ করতে এয়চিলো সব… যকন হাতীবাগানে জাপানী বোম পড়লো… ইয়া ধুমসো ধুমসো আবলুস কালো চ্যায়রা…।”
এতক্ষণে হৃদয়ঙ্গম হল। টমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শহরে আসা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান সৈন্যদল। বুড়িদির অননুকরণীয় অ্যাকসেন্টে যারা নিগ্রো থেকে ‘নেঙড়ো’তে পরিণত হয়েছে।
প্রজেক্টের কাজটা শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হল। অনেকদিন যাওয়া হয়নি ওদিকটায়। জানি না অসাধারণ সুরেলা গলায় ইন্দুবালা, আঙুরবালা, ছোটটেঁপির ঠুমরি-গজল আর গর্ভে বিশালদেহী, প্রবল বলশালী, ঘোর কৃষ্ণকায় অনার্য সন্তান ধারণ না করতে পারার আক্ষেপ নিয়ে বুড়িদি আজও টিকে আছেন কি না।
“বোঝলেন দাদা, এইবার পোলাডার একডা বিয়া দিমু। বয়স তো হইলো। আঠাইশ ছাড়াইসে এই বৈশাখে।” পাশে দাঁড়ানো প্রতিমাদি বলে চলেছেন ছেলের কথা। প্রতিমাদি পঞ্চাশোর্ধ। কালীঘাট লাইনপাড়ায় তবলাগলিতে একচিলতে ঘুপচি ঘর। পুরনো যৌনকর্মী। সেই কবে এঘাট, ওঘাট, বহুঘাটের জল খেয়ে ভাসতে ভাসতে এসে উঠেছিলেন এই এঁদোখাল থুড়ি বুড়িগঙ্গার পাড়ে। এখন লাইন ছেড়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বাপি। কালীঘাটের গলিতে বেড়ে ওঠা জবালার সন্তান। ওরকম একটা পরিবেশে বড় হয়েও মদ গাঁজা তো দুরস্থান, একটা সুপুরির কুচিও মুখে তোলেনি কোনওদিন। পাড়ায় কখনও কেউ একটা মুখখারাপ করতে শোনেনি ওকে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলত। পজিশন মিডফিল্ডার। বাঁ পায়ে দুরন্ত সোয়ার্ভিং কিক। বাঁক খেয়ে ঢুকে যেত নেটে। ঠিক রোনাল্ডিনহোর মতো। স্বপ্ন দেখত রোনাল্ডিনহো হবে। সাও-পাওলার ঘিঞ্জি বস্তি থেকে উঠে গিয়ে স্বপ্নের ব্রাজিল টিমে। ভাবা যায়! রোনাল্ডিনহো পারলে বাপি পারবে না কেন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, তারপর ইন্ডিয়ার জার্সি… সব হবে একদিন। হবেই হবে।
রোজ কাকভোরে উঠে জার্সি, বুট কাঁধে লেকের মাঠে দৌড়োত বাপি। বাবুদা-খোকনদাদের কোচিং ক্যাম্পে। ওরাও ভরসা দিতেন খুব— “তোর হবে, হবেই। খেলাটা কিন্তু ছাড়বি না কিছুতেই। যত কষ্টই হোক।” তা সেই অ্যাতো কষ্টের মধ্যেও কিন্তু পাড়ার স্কুলে মাধ্যমিকটা পাস করে ফেলেছিল বাপি। কিন্তু ওই যে বলে… তরতরিয়ে ছুটতে থাকা রোনাল্ডিনহো হবার স্বপ্নটায় চিড় খেয়ে গেল একদিন। লেক মাঠে ইন্টার স্কুলে টুর্নামেন্টে অপোনেন্টের মারকুটে ডিফেন্ডারের লঙ স্টাড বুটের একটা সলিড চার্জ। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে তিন টুকরো বাঁ পায়ের সিনবোন। সঙ্গে সেই কোন ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা স্বপ্নটাও, খতম ফুটবল কেরিয়ার। ওই সিনেমার ভাষায় যাকে বলে— ‘দ্য এন্ড!’
বাপি এখন বাঁ-পাটা সামান্য টেনে টেনে হাঁটে। দিনের বেলা যৌনকর্মীদের স্বশাসিত সংস্থায় অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাজ করে। আর সন্ধের পর পেঁকো দুর্গন্ধ উঠে আসা খালপাড়ের নাইটস্কুলে পাড়ার পুঁচকেগুলোকে পড়ায়। ওর মধ্যেই কোনটার পায়ে বল একটু বেশি রকম কথা শুনেছে দেখলেই ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয় লেকের মাঠে। বাবুদাদের কোচিং ক্যাম্পে। নিজেও পৌঁছে যায় মাঝেসাঝে। ছুটিছাটার দিনে। সস্তা কেরোসিন কাঠের আলমারি থেকে নামিয়ে আনা রং জ্বলে যাওয়া মলিন ট্রাকস্যুট আর তাপ্পি মারা স্পোর্টস সু। তিন টুকরো হয়ে যাওয়া সিনবোন কেড়ে নিয়েছে বাঁ-পায়ের বাঁক খাওয়ানো ব্যানানা কিক আর রোনাল্ডিনহো হয়ে ওঠার স্বপ্ন। কিন্তু কাড়তে পাড়েনি সবসময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ভারী মিষ্টি হাসিটা আর উজ্জ্বল দুটো চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি এখন মাঝমাঠে। বল নিয়ে দৌড়োচ্ছে কুচোকাঁচাগুলো। ঘামে ভেজা মুখগুলো চকচক করছে ভোরবেলার রোদে। ময়দান মার্কেটের সস্তা জার্সি লেপটে রয়েছে গায়। সেদিকে তাকিয়ে বাপির উজ্জ্বল চোখ দুটো উজ্জ্বলতর। “আমার হয়নি, ওদের হবে না? হবেই। কী বলেন দাদা?”
সেই কবে পরনে জিন্স, একতারা দোতারার বদলে হাতে গিটার মানুষটি গেয়ে উঠেছিলেন ‘আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু-আনা।’ সত্যিই তো, বাকি দু-আনা পেয়ে যাওয়ার আশা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে বাপি।