প্রায় এই একইরকম আর-এক ধরনের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন শহরে। তবে এদের জন্য খাঁটি মধুর জায়গায় খাঁটি ঘি। যার প্রায় ষাট শতাংশ সস্তা বনস্পতি আর ক্ষতিকারক ভেজিটেবল অয়েল। সঙ্গে নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স, যথারীতি, বাকি ব্যাবসার টেকনিকটা মধুর মতোই হুবহু এক। স্রেফ চিটিংবাজি আর বাকচাতুর্যকে মূলধন করে এই ‘খাঁটি’ বেওসাদাররা আজও দিব্যি করেকম্মে খেয়ে যাচ্ছেন আমাদের এ শহরে।
…কত রং বদলায়
শেয়ালদা প্রাচী সিনেমার উলটোদিকে এন আর এস হাসপাতালের গা ঘেঁষে যে সুড়ঙ্গপথটা (সাবওয়ে) সোজা শেয়ালদা স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে কোনওদিন যদি হেঁটে যান, চোখে পড়বে সবজিওয়ালি মাসি আর হরেকরকম পসরা সাজিয়ে বসা ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকের মাঝখানে হাতের বাঁদিকে বসে থাকা দু’-তিনজন। সামনে একটা স্টিলের প্লেটে ছোট ছোট রঙিন পাথর আর পাশে একটা বাটিতে সাদা পাউডার গোলা জল। পিছনে ফ্লাইওভারের দেয়ালে আঁকা কালীমূর্তির ছবি। তলায় ক্যাপশন— ‘এখানে ভাগ্য বিচার করে সঠিক পাথর দেওয়া হয়।’ কৌতূহলী পথচারীরা উঁকিঝুঁকি মারছেন। কেউ একটু বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলা হচ্ছে। কালীমূর্তির ছবির নীচে বসে থাকা একজন, ফর্সামতন, বোধহয় দলটার পাণ্ডা, সম্ভাব্য খদ্দেরকে প্রশ্ন করছে নিচু গলায়— “কিনবেন তো?” খদ্দের রাজি হওয়ামাত্র আঁজলা পাতার মতো করে ডান হাত পাততে বলা হচ্ছে। স্টিলের প্লেট থেকে একটা করে পাথর তুলে খদ্দেরের হাতে রেখে একটা ছোট চামচে দিয়ে পাউডার-গোলা জল ঢালা হচ্ছে হাতে। পরমুহূর্তেই পাথরটা তুলে নিয়ে একটা অন্য পাথর বসানো হচ্ছে। ফের নতুন করে জল ঢালা হচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ প্রক্রিয়াটা চলার পর একটা পাথর বসিয়ে হাতে জল ঢালতেই আশ্চর্যজনকভাবে সাদা পাউডার গোলা জলের রং বদলে লাল হয়ে গেল। হতবাক খদ্দের! বিক্রেতার গলা চড়ছে। “দেখলেন তো কীরকম রং বদলে গেল। আপনার হাতের রেখার সঙ্গে মিলে গেলে তবেই জলের রং বদলাবে। নচেৎ কিছুতেই নয়। তার মানে আপনার দরকার গোমেদ। বাজারে আসল গোমেদ কিনতে গেলে ট্যাঁক থেকে হাজার টাকা খসে যাবে। এই পাথরটা গোমেদের বিকল্প। আপনার ভাগ্য ভাল তাই মাত্র দুশো টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন।” চমকিত খদ্দের। মাত্র দুশো টাকায় গোমেদের বিকল্প! মানে তুঙ্গে বৃহস্পতি। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে বেরিয়ে আসা মানিব্যাগ। ঝটিতি হাতবদল হয়ে যাওয়া করকরে দু’খানা একশো টাকার নোট। কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস, “শনি অথবা মঙ্গলবারে পুজো দিয়ে রুপো বাঁধানো আংটিতে বসিয়ে ধারণ করবেন। ওইদিনটা টক খাবেন না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলকিত খদ্দের। ভাগ্যের রং বদলানোর আনন্দে মোড়কটা পকেটে পুরে পা বাড়াচ্ছেন গন্তব্যস্থলের দিকে।
ভাগ্যের রং কি সত্যিই বদলাল? আরে না মশাই। কিছুই বদলাল-টদলাল না। আসলে এই গোটা ব্যাপারটাই একটা ফক্কিকারির খেল। নির্ভেজাল চিটিংবাজি। দৈবটৈব কিস্যু নেই এর মধ্যে। প্লেটে রাখা ওই পাথরগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটায় হালকা করে ছোঁয়ানো রয়েছে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট। কোন পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো রয়েছে সেটাও বিক্রেতার মুখস্থ। যে পাথরগুলোয় রাসায়নিক লাগানো নেই প্রথমে সেরকম কিছু পাথর হাতে বসিয়ে জল ঢালা হচ্ছে। খদ্দেরের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার জল। অতপর মওকা বুঝে রাসায়নিক লাগানো পাথর প্রয়োগ করা হচ্ছে। রসায়নের নিয়ম অনুযায়ী পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট জলের সংস্পর্শে এলেই তা লাল অথবা গাঢ় গোলাপি রং ধারণ করে। খদ্দের ভাবেন ভাগ্যের রং বদলাচ্ছে। অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের কী মর্মান্তিক পরিহাস!
অল দ্যা গ্লিটারস ইজ নট…
রাস্তা দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ চোখে পড়ল ফুটপাতের ধারে পলিথিন শিটের ওপর ছড়িয়ে রাখা ঝকঝকে সেলোফেন পেপারে মোড়া দামি দামি শাড়ি, ঢেলে বিক্রি হচ্ছে। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রেতা। বিক্রেতাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। শাড়ি বাছাবাছি করছে। কেনাকাটাও চলছে মন্দ না। আপনার কৌতূহল হল। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ক্রেতাদের ভিড়ের মাঝখানে। শুনতে পাবেন ফিসফাস, টুকরোটাকরা বার্তালাপ। ক্রেতারা নিচুগলায় কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে— “আরে বাবা!… পিওর জরদৌসি… কী করে অত সস্তায় দিচ্ছে!” “সেটাই তো ভাবছি মশাই, এটা তো বালুচরি… বাজারে অন্তত পাঁচ হাজার… এখানে মাত্র দেড় হাজার চাইছে… জাস্ট ভাবা যায় না!” এককোণে দাঁড়ানো বিক্রেতা, জবাব দিচ্ছে কিছুটা দুখী দুখী বিষণ্ণ গলায়— “সবই কপাল স্যার, মহাজন ফেল মেরেছে। কোম্পানিতে লালবাতি জ্বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে…।” শুনেটুনে আপনার কৌতূহল বাড়ল। এত লোক কিনছে। ভাবামাত্র উবু হয়ে বসে পড়লেন ফুটপাতে। বাছাবাছি করে কিনে ফেললেন একটা পাটোলা বা কাঞ্চিভরম। মাত্র হাজার টাকায়। তাড়াহুড়ো করে ভরে ফেললেন ব্যাগে। যুদ্ধজয়ের আনন্দে হাঁটা লাগালেন তড়িঘড়ি, বাড়ি ফেরার বাস ধরবেন বলে। কোন মহাজন ফেল মেরেছে? কোথায় অথবা কেন লালবাতি জ্বলেছে? এত দামি দামি শাড়ি হঠাৎ কেন এত সস্তায় দিচ্ছে? ভেবেও দেখলেন না একবার। আনন্দে প্রায় উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেই গিন্নির ‘স্টিং অপারেশনে’র সামনে সব ঘোটালার পরদা ফাঁস। পচা রদ্দি পাটফেঁসো শাড়ি। অতঃপর সারা সন্ধে একটানা সিরিয়াল ব্লাস্ট, প্রবল গঞ্জনা। গৃহিণী কর্তৃক বিশ্বের সবচেয়ে নির্বোধ মানুষের শিরোপা লাভ। এককথায় হিউমিলিয়েশনের একশেষ। ফলস্বরূপ বিনিদ্র রজনী। হাজার টাকার শোক। হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকা নাইট ল্যাম্পের আলোয় ঘুরন্ত পাখার দিকে। পরদিন চিরতা খাওয়া মুখে ফের যাত্রা কর্মস্থলের উদ্দেশে। মাঝখানে টুক করে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া ফুটপাতের ওই নির্দিষ্ট জায়গাটায়। কেউ নেই। সব ভোঁ ভোঁ।