প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ যে দৃশ্যক্রমের বর্ণনা দিলাম আপনাদের, সে ব্যাপারে একটু খোলসা করে বলি এবার। ওই স্কুটার চালক আসলে একজন ভ্রাম্যমাণ মদবিক্রেতা। পুরো ব্যাবসাটাই চলে কালোবাজারে। এরকম আরও অন্তত পনেরো-কুড়িজন মোবাইল ওয়াইন সেলার রয়েছে রুবি থেকে গড়িয়া, এই বাইপাস সংলগ্ন এলাকাটা জুড়ে। এ কাজে সবারই বাহন স্কুটার অথবা বাইক। নিপ, পাঁইট আর বোতলপিছু কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা বেশি পড়ে। রাত দশটার পর লাইসেন্সড মদের দোকানগুলো ঝাঁপ বন্ধ করার পর কারবারটা শুরু হয়। এই বিক্রেতা অথবা তাদের বাহনদের একাধিক কোডনেম রয়েছে ক্রেতামহলে। যেরকম ‘রাম-রথ’, ‘টান্টু মেল’, ‘বুজ এক্সপ্রেস’, ‘টাল্লাগাড়ি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ছুটিছাটা, উৎসব বিশেষত দুর্গাপুজো, দোল, দেওয়ালি, কালীপুজো, বড়দিন, থার্টি ফার্স্ট নাইট আর গান্ধি জয়ন্তীতে (ওইদিন মদের দোকান বন্ধ থাকে) চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দামও যায় বেড়ে। পুরনো এবং পার্মানেন্ট কাস্টমারদের জন্য হোম ডেলিভারিরও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই…
শহর বাড়ছে। যাদবপুর, টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে গড়িয়া টপকে বোড়াল হয়ে সেই কামালগাজি, নরেন্দ্রপুর, সোনারপুর, বারুইপুর… হাইরাইজ, স্কাইস্ক্র্যাপার, সারসার ফ্ল্যাটের জঙ্গল। নগরায়ণের বিষাক্ত থাবায় অবাধে বোজানো হচ্ছে মাইলের পর মাইল পুকুর, জলাভূমি, নির্বিচারে কাটা পড়ছে লক্ষ লক্ষ গাছ। চাষজমিকে পায়ের তলায় থেঁতলে মাথা তুলছে বহুতল। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিপদে পড়ছে সেখানকার মনুষ্যেতর বাসিন্দারা। সাপ, ব্যাঙ, মাছ, প্রজাপতি, কেঁচো, পাখি, ভাম, ভোঁদড়, শেয়াল… আরও কতশত প্রজাতি। কিন্তু ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাবেটা কোথায়। ফলে মরছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দলে দলে। এর মধ্যেই নাছোড় কেউ কেউ, এখনও তাদের সেই কবেকার, আদ্যিকালের ভিটে ছাড়তে নারাজ। তাই কংক্রিটের জঙ্গলে ফ্ল্যাটবাড়ির ভেন্টিলেটরে এখনও খড়কুটো জুটিয়ে এনে বাসা বাঁধছে চড়াই। ডিম, ছানাপোনা বিয়োচ্ছে। জল আর ঝোপঝাড়ের অভাবে পাকা রাস্তার ওপর এসে বসে থাকছে নিঃসঙ্গ কুনো ব্যাঙ। এখনও না কাটা পড়া জামগাছটার ডালে কচিৎ কদাচিৎ উঁকিঝুঁকি মারা হতাশ লক্ষ্মীপ্যাঁচা, রোগা রোগা কাঠবেড়ালী। খাবার নেই, তাই ফ্ল্যাটবাড়ির রান্নাঘরের জানলা গলে হানা দিচ্ছে ভাম। মাঝে মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ে যাওয়া জোড়া শালিখ নেচে বেড়াচ্ছে ঝুল বারান্দার কার্নিশে। একগাদা আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ভারী বিপদে পড়ে যাওয়া বেজি-মা। দিগ্ভ্রান্তের মতো ঘুরঘুর করছে এদিক ওদিক। বুঝতে পারছে না লুকোবে কোথায়। এদের মধ্যে আরও একদল রয়েছে যারা এই উচ্ছেদ হওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি কিছুতেই। সাপ। সুদৃশ্য ড্রইংরুমে সোফার নীচে, কাবার্ডের তলায়, বেডরুমে আলমারির পিছনে, বাথরুমে কমোড ফ্ল্যাশের ঢাকনার ওপর… সর্বত্র অবাধ বিচরণ এদের। লেজের ডগাটুকু চোখে পড়া মাত্র গেরস্থর তীব্র ভয়মিশ্রিত চিৎকার, চ্যাঁচামেচি… প্রবল আতঙ্ক! আর এই আতঙ্কই দরজা খুলে দিচ্ছে এক অদ্ভুত জীবিকার। সাপুড়ে বা বেদে। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বা বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই যাযাবর শ্রেণির মানুষরা মাঝে মাঝেই এসে হানা দেয় এইসব সদ্য গজিয়ে ওঠা আবাসনগুলোয়। মুখে হাজার রকম বুলি— “ঘরে সাঁপ আছে গোওও… নাগের বাস (গন্ধ) পেতেছি, সাঁপ ধরাবে নাকি গোওওও…” অথবা “ঘর মে সাঁপোয়া ঘুঁস গৈলে। হাম বানজারা, সাঁপোয়া পাকড়বে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। এই হানা দেওয়ার ব্যাপারটা ঘটে মূলত দুপুরের দিকে। সাধারণত ওই সময়টায় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কেউ বাড়িতে থাকেন না। সাপুড়েদের ভয়মাখানো বুলিতে চরম সন্ত্রস্থ গৃহকর্ত্রী। ঘরের মধ্যে সাপ! দু’দিন আগে নাকি মিসেস বাসুর ফ্ল্যাটে দেখা গেছিল। লোকগুলো যা বলছে তাতে যদি আমার ঘরেও থাকে? এই ভয়ের রন্ধ্রপথে ঘরে ঢুকে পড়ে সাপুড়েরা। ঢুকেই সন্দেহজনক চোখে চারদিক দেখে নিয়ে নাকটাক শুঁকে শুরু হয় আরেকপ্রস্থ ভয় দেখানোর পালা। “ইয়া বড়কা কোবরা নাগ!… বহোত বিষনি (বিষাক্ত)! পাকড়নেমে বহোত তকলিফ হোগা… পাঁচশ রুপিয়া লাগেগা।” ভয়ে আধমরা গৃহকর্ত্রী। শুরু হয় কাতর গলায় অনুনয় বিনয়— “একটু কমসমে হয় না বাবা।” শেষ অবধি তিনশো কি চারশোয় রফা হয়। এইখানে পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, দুয়েকটি ক্ষেত্রে এর সত্যতা থাকলেও সাপুড়েদের এই ভয় দেখানোর খেলাটা শতকরা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ্যে এবং লোকঠকানো। ঢোলা জামা বা পাঞ্জাবির আস্তিনের ফাঁকে লুকোনো থাকে বিষদাঁত ভাঙা চন্দ্রবোড়া, কালাচ, শাঁখামুঠি, গোখরো বা খরিশ কেউটে। নিদেনপক্ষে নির্বিষ ঢোঁড়া, হেলে, দাঁড়াশ, কালনাগিনী বা লাউডগা। নিখুঁত হাতসাফাইয়ের খেলায় সেগুলোকেই আস্তিনের ফাঁক থেকে বের করে এনে দেখানো হয় বাড়ির লোকজনকে। চরম আতঙ্কগ্রস্ত বাড়ির লোকজন। সাপুড়েদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিয়ে রক্ষা পান ভয় থেকে। এই একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম সেই ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর। গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছি। ভবানীপুরে পুরনো পাড়া ছেড়ে বেহালার সরশুনায় নিজেদের বাড়িতে উঠে এসেছে মামারা। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। সরশুনা, চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, পুকুর-ডোবা-নালা, মাঝে মাঝে ছিটেবেড়া আর টালির চালের উদ্বাস্তু কলোনি। ইতিউতি দু’-চারটে সদ্য নির্মীয়মাণ ইটের দাঁত বের করা সিমেন্টের প্রলেপহীন বাড়ি। নিঝুম ঘুঘুডাকা দুপুর আর রাত নামলেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার চারদিকে। সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুইপাখির সাইজের ভ্যাম্পায়ার মশা। মনে আছে ঠিক এরকম একটা দুপুরে, মামারা সব অফিসে, বাড়িতে হানা দিয়েছিল সাপুড়ের দল। মামিদের ভুজুংভাজুং দিয়ে রান্নাঘরের সিঁড়ির তলায় কয়লা রাখার অন্ধকার খুপরিটা থেকে ধরে নিয়ে গেছিল হাত তিনেক লম্বা একটা দাঁড়াশ, সঙ্গে নগদ পাঁচটা টাকা। তখনকার বাজারে অঙ্কটা অনেক। ভয়ে দুর্গানাম (নাকি মনসা?) জপতে জপতে সাপুড়েদের টাকা মিটিয়ে স্বস্তির হাঁফ ছেড়েছিল মামিরা। আজ এতদিন বাদেও কথাটা মনে পড়লে মনে মনে হাসি আর এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় ভাবি— ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’
খাঁটি বেওসা
ফুটপাতের ধারে বিশেষ করে অফিসপাড়ায় চোখে পড়বে দৃশ্যটা। একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে গোঁজা খেজুরপাতা, বালতিভরতি মধু, ওপরে ভাসছে ভাঙা মৌচাকের টুকরো, মৌচাকের ওপর ইতিউতি উড়ে অথবা ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা মৌমাছি। পাশে বসা ফেরিওয়ালা। হাতে বালা, কানে মাকড়ি, গলায় রংবেরঙের পাথর বসানো হার। যাযাবর বানজারা টাইপের চেহারা। থেকে থেকে হাঁক পাড়ছে মধ্যমস্বরে। “মধু লে লো বাবু, আসলি জংলি মধু… জঙ্গল সে তোড়কে লায়া…।” মধু যে কতটা খাঁটি সেটা প্রমাণ করার জন্য একটা দশ টাকার নোটে মধু মাখিয়ে দেশলাই জ্বেলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। নোটটা পুড়ছে না। খাঁটি মধু মাখানো কোনও জিনিস নাকি আগুনে পোড়ে না— দাবি করছে লোকটা। কথার জাগলারিতে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমাচ্ছেন পথচারীরা। বিক্রিবাট্টাও হচ্ছে ভালই। খাঁটি মধু কিনে বাড়ি ফিরছেন পথচারীরা এবং অতি অবশ্যই ঠকছেন। কারণ ওই খাঁটি মধুর বারো আনাই ভেলি বা চিটেগুড়ের রস। দু’আনা লিকুইড গ্লুকোজ, ঘনভাব আনার জন্য, এক আনা নকল স্বাদগন্ধের এসেন্স আর বাকি একআনা সত্যিই খাঁটি মধু। আর মধুর বালতির ওপর মৌমাছি ওড়াটি কোনও ব্যাপারই না। শুধু মধু নয়, চিনির বস্তা বা ভেলিগুড়ের ঢেলার ওপরেও মৌমাছি ঘুরঘুর করে। যে-কোনও গুড়-বাতাসার দোকানে গেলেই ব্যাপারটা মালুম হবে। এদিকে নোট না পোড়ার রহস্যটা স্রেফ কেমিক্যালের কারসাজি। কিনে নিয়ে গিয়ে দু’দিন বাদেই ভুল ভাঙছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল— ঘরে গৃহিণীর গঞ্জনা, পুত্র-কন্যার পরিহাস। বেচারা মধ্যবিত্ত অফিসবাবু!