সোনাগাছির বাইরে আরও এক জায়গায় এই দালালদের অস্তিত্ব ছিল। আজ থেকে সাত-আট বছর আগেও যাদের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, সদর স্ট্রিট, বেড ফোর্ড লেন, মার্কুইস স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলে যাতায়াত ছিল, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সন্ধের দিকে ওইসব এলাকা ধরে হেঁটে গেলে কানের কাছে ফিসফিস ডাক— “চলিয়ে স্যর… কলেজ গার্ল স্যার…।” পাশাপাশি হেঁটে চলা একটা লোক। গলায় ক্রমাগত কাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলা নাছোড় আহ্বান। আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজি হলেই কাস্টমারকে সঙ্গে নিয়ে সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ কোনও একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে লোকটা। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে “খোঃ” (খোল?) জাতীয় হাঁক পাড়বে একটা। ভেতর থেকে খুলে যাবে দরজাটা। একতলায় অথবা দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে সামনেই একটা ড্রইং রুম মতো। সোফায় সার দিয়ে বসা মেয়েরা। কাস্টমারের অপেক্ষায়। কাউকে পছন্দ হলে সঙ্গে নিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়া দুপাশের খোপ খোপ ঘরে। এক্ষেত্রেও ধান্দার নিয়মটা হুবহু সোনাগাছির মতোই, কাস্টমারের থেকে টাকা চাওয়ার প্রশ্নই নেই। মেয়েটিকে কাস্টমারের দেয় অর্থের থেকে পার্সেন্টেজ নিয়ে নেবে দালাল। তফাত শুধু একটাই সোনাগাছির দালালরা প্রায় সকলেই হিন্দু আর ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অঞ্চলের দালালরা একশো শতাংশ বিহারি মুসলমান। কোনও অজ্ঞাত কারণে নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে ওইসব অঞ্চলের ‘খালি কুঠি’গুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে ওই চত্বরে আর একটিও এ ধরনের বাড়ি টিকে রয়েছে বলে এই অধম প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। ফলে একমাত্র সোনাগাছি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর অন্য কোনও নিষিদ্ধ পল্লিতে দালাল বা চাকরের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
কালো পলিপ্যাক রহস্য
এই অভিজ্ঞতাটিও হয়েছিল সোনাগাছিতেই। সেই সকাল থেকে নিয়ে রাত অবধি চানাচুর, ঝালমুড়ি, ঘুগনি, আলুর দম, আখের রস, ছোলাভাজা, বাদাম, চানামশলা, আলুকাবলি, শাড়ি, জামাকাপড়, বেডশিট… কত ধরনের ফেরিওয়ালা যে আসে সোনাগাছিতে তার ইয়ত্তা নেই। এরই মধ্যে একদিন, দুপুরবেলার দিকে চোখে পড়েছিল লোকটাকে। সাইকেলের সামনে পিছনে ঝোলানো স্টেইনলেস স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাটি, হাঁড়িকুড়ি, আরও একাধিক বাসনপত্র। হাতে একটা ডুগডুগি। থেকে থেকে সেটা বাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। লোকটাকে দেখামাত্র বাড়িগুলোর দরজায় দাঁড়ানো মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। ফিরেও এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবার হাতে ঝোলানো একটা করে কালো পলিপ্যাক। দৌড়ে এসে ভিড় জমাল ফেরিওয়ালার সামনে। ধীরে সুস্থে সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে এক এক করে প্রত্যেকের হাত থেকে পলিপ্যাকগুলো নিয়ে ভেতরে হাত চালিয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করল লোকটা। তারপর ওজন অনুসারে মেয়েদের হাতে তুলে দিতে লাগল থালা, বাটি, গ্লাস, অন্যান্য বাসনকোসন। ওজন নিয়ে একটু আধটু বিতর্ক যে হচ্ছিল না তা নয়। তবে সবটাই মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে। একটা পলিপ্যাকের সর্ব্বোচ্চ ওজন হয়েছিল সাড়ে সাতশো গ্রাম। বিনিময়ে সেই পলিপ্যাকের মালকিন পেয়েছিল ইয়া পেল্লায় সাইজের ছ’বাটির একটা টিফিন বক্স। কিন্তু পলিপ্যাকের মধ্যে আছেটা কী? তীব্র কৌতূহল জেগেছিল মনে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম— মাথার চুল। নকল চুল বা পরচুলা তৈরির কাজে লাগে। এক্সপোর্টও হয় নাকি অত্যন্ত চড়া দামে। তা বলে শুধু কালো পলিপ্যাকেই কেন? মেয়েদের প্রশ্ন করে যে উত্তরটা পেয়েছিলাম তা শুধু অভিনবই নয়, রীতিমতো চমকপ্রদ। কাটা চুল নাকি খোলা দেখাতে নেই। তাতে নাকি অমঙ্গল হয়। শোনার পর বিস্ময়ে ঝুলে যাওয়া চোয়াল বন্ধ হতে সময় লেগেছিল মিনিটখানেক।
ওজন জাদু
সামনে দাঁড়ানো নধর একটা খাসি। খাসিটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন বাহাল ভাই। একদৃষ্টে জরিপ করছেন খাসিটাকে। মিনিটখানেক বাদে নজর আন্দাজি সেরে নিয়ে খাসিটার বুকের মাঝখানে হাত ঢুকিয়ে সামনের পা দুটো জমি থেকে ইঞ্চিছয়েক ওপরে তুলে ফের নামিয়ে দিলেন মাটিতে। ঘুরে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন— “লগবগ (মোটামুটি) বাইশ কিলো গোস্ত হোগা, হাড্ডি চামড়া ছোড়কে।” পিছনে দাঁড়ানো দু’জন। খাসির ক্রেতা। “শুক্রিয়া বাহালভাই,” বলে ঘাড় নাড়ল আশ্বস্তভাবে।
প্রিয় পাঠককুল, আসুন এবার বাহালভাইয়ের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। সত্তরের দশকের একদম গোড়ার দিকে লখনউ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন মানুষটি। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর উলটোদিকে বেঙ্গল মিট শপ নামে ছোট একটা খাসির মাংসের দোকান দিয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যাবসা। সেই ছোট মাংসের দোকান থেকে ব্যাবসা বাড়তে বাড়তে পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর গায়ে বিখ্যাত মোগলাই খানার ঠিকানা জিশান হোটেলের মালিক আজ বাহালভাই। তবে মানুষটার এই প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এতখানি ওপরে উঠে আসার গল্প শোনাবার জন্য এ লেখা লিখতে বসিনি আমি। এ সবের বাইরেও এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে বাহালভাইয়ের। যাকে প্রায় অলৌকিকত্বের পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। যে-কোনও খাসির সামনের পা জোড়া মাটি থেকে সামান্য ওপরে তুলে প্রাণীটির নিট মাংসের ওজন প্রায় নিরানব্বই ভাগ সঠিক বলে দিতে পারেন বাহালভাই। যার বর্ণনা একটু আগে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তীতে দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে ওজন করলে মেরেকেটে বড়জোর পাঁচশো গ্রাম থেকে এককেজি এদিক ওদিক হবে। তার বাইরে কিছুতেই নয়। ওয়াটগঞ্জ, রাজাবাজারে খাসির হাটগুলোয় বাহালভাইয়ের মতো মানুষদের ওস্তাদ বা খলিফা নামে ডাকা হয়। সারা শহরে এ রকম খলিফা নাকি মাত্র পাঁচ-ছ’জন রয়েছেন। ফলে খাসির হাটে এই ওস্তাদ বা খলিফাদের চাহিদা প্রচণ্ড। বড় বড় ক্রেতা মহাজনরা চোখ বুজে নির্ভর করেন এদের ওপর। আর এই ভরসার কারণটা সহজেই অনুমেয়। একটা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এই কাজটা করে থাকেন খলিফারা। সেটা হল খাসিপিছু পাঁচশো থেকে এককেজি মাংসের দাম।