প্রিয় পাঠককুল, এতক্ষণ ধরে উপরোক্ত বর্ণনাটি পড়ে কিঞ্চিৎ ধন্ধে পড়ে গেছেন আশা করি। মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর কাটা ছেঁড়া পালক দিয়ে মন্টু করবেটা কী? কৌতূহল নিরসনের জন্য জানাই, ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’ এই লাইনটা বোধ হয় মুরগির ক্ষেত্রেও সত্যি। মাংস ছাড়াও গিলে, মেটে, কলিজা, মাথা, গলা, ছাঁট সবকিছুই বিক্রি হয়ে যায় খাদ্য হিসেবে। এরপরেও যা পড়ে থাকে, সেই বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক, আমাদের চোখে যা বর্জ্য এবং পরিত্যাজ্য— সেটাই অন্য কারও উদরপূর্তির উপকরণ। সায়েন্স সিটির উলটোদিকে বাইপাসের ধারে যে বাস রাস্তাটা বানতলা, ধামাখালি, ঘটকপুকুর হয়ে সোজা সুন্দরবনের দরজা সন্দেশখালি অবধি চলে গেছে— সেই রাস্তাটা ধরে মাইল পাঁচেক এগোলেই একধারে বিদ্যাধরী নদী, অন্যপাশে অজ পাড়াগাঁ। সারি সারি মাছের ভেড়ি। ভেড়িভরতি মাছ। রাক্ষুসে মাগুর (জায়ান্ট আফ্রিকান ক্যাটফিশ), নাইলোটিকা (ত্যালাপিয়ার জাতভাই), পাকু (আমাজন নদীর হিংস্র পিরানহার নিরীহ জ্ঞাতি)… আরও হরেকরকম প্রজাতি। প্রায় সবই হাইব্রিড। মন্টুরা সব এই ভেড়ি অঞ্চলের মানুষ। সেই কাকভোরে, সূর্যের আলো ঠিকঠাক ফোটার আগেই সাইকেলের পিছনে ড্রাম ঝুলিয়ে এরা বেরিয়ে পড়বে বাড়ি থেকে। চলে আসবে আমাদের এই শহরে। দোকান দোকান ঘুরে সংগ্রহ করবে মুরগির বর্জ্য। চাহিদা আর জোগান অনুযায়ী দাম কিলোপ্রতি পনেরো থেকে কুড়ি টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। দোকানদারের সঙ্গে হপ্তা অথবা মাসকাবারি চুক্তি। সওদাপাতি সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। গ্রামে অপেক্ষারত ক্রেতার দল, ভেড়ির মালিকের লোকজন। মাল নামার সঙ্গে সঙ্গে খড়-কুচোনো মেশিনে পালক কুচিয়ে পুরীষমাখানো মণ্ড তৈরি করে ফেলে দেওয়া হবে জলে। মুহূর্তে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে ভেড়ির জল জুড়ে। ড্রামকে ড্রাম বর্জ্য নিমেষে চলে যাবে মাছের পেটে। আর মন্টুরা? ভারী ভারী ড্রাম সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে মাইল মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার হাড়ভাঙা ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যাবে ঘরে। তারপর কোনওমতে নাকেমুখে কিছু গুঁজে গড়িয়ে পড়া বিছানায়। কাল ভোরে উঠে আবার অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শহরে পৌঁছতে হবে যে।
শিশুখামার
রাস্তাঘাটে আসতে যেতে আপনাদেরও অনেকের হয়তো মাঝেমধ্যে চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। এক মহিলা। পরনে ছেঁড়াফাটা মলিন শাড়ি। পাশে নোংরা চাদরের ওপর শোয়ানো একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা। অঘোর ঘুমে অচৈতন্য। মুখের সামনে কাত হয়ে থাকা আধখালি জলমেশানো দুধের বোতল। অফিসপাড়া। ব্যস্ত পাড়া। ব্যস্ত জনপদ। ভিড়ভাড়াক্কার মধ্যে দিয়ে জলদি পা চালানো পথচারীদের অনেকেরই নজর চলে যাচ্ছে সেদিকে। একটাকা, দু’টাকা, পাঁচটাকার কয়েন ছুড়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। পরক্ষণেই আরও দ্রুত পা চালাচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখতে পেতেন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে ওই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ঠায় একইভাবে বসে আছে মহিলা। বাচ্চাটা তখনও ঘুমিয়ে কাদা। সকালের মতোই থেকে থেকেই টুপটাপ পয়সা পড়ছে চাদরের ওপর। একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা, নড়াচাড়া নেই, দুষ্টুমি নেই, কান্নাকাটি নেই, সকাল থেকে সন্ধে অবধি একটানা ঘুমে আচ্ছন্ন। ব্যাপারটা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক হলেও সকাল বিকেল অফিস-বাড়ি-অফিস ব্যস্ত পথচারীদের খটকা লাগছে না প্রায় কারোরই। এই প্রতিবেদকের কিন্তু লেগেছিল। নানা কাজের চাপে খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি সেভাবে। সুযোগটা এসে গেল হঠাৎই একদিন। সেটা নব্বই সালের গোড়ার কথা। একটা নামী সমীক্ষা সংস্থার সোশ্যাল রিসার্চ ডিভিশনে চাকরি করি তখন। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের দীর্ঘমেয়াদি বরাত পায় আমাদের সংস্থাটি। বিষয়— ‘চাইল্ড ট্র্যাফিকিং, অ্যাট্রোসিটি অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেশন।’ দেশের পূর্বাঞ্চলে সমীক্ষার ভার পড়েছিল আমার হাতে। কাজটা হাতে নিয়ে প্রথমেই সমীক্ষা চালাই উপরোক্ত বিষয়টির ওপর। দিনের পর দিন শহরের অলি গলি ঢুঁড়ে ফেলে যে তথ্য (নাকি দৃশ্য?) সামনে উঠে এসেছিল সেটা এককথায় চমকপ্রদ। ওই ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটা আসলে একটা ব্যাবসা। আসলে বাচ্চাটা ঘুমোয় না। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু কীভাবে? প্রশ্নের উত্তরটা পেতে জনাদশেক এরকম ভিখিরিকে খুঁজে বের করেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করে যা উঠে এসেছিল তা এককথায় হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। মোটামুটি দুরকম পদ্ধতিতে এই ব্যাবসাটা চলে। এক— ফুটপাতের ধারে ঘুমন্ত শিশুটিকে শুইয়ে রেখে ভিক্ষে চাওয়া। দুই— ঘুমন্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করা। ব্যাবসাটার নির্দিষ্ট কয়েকটা নিয়মকানুন আছে। কোনও ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাকে কখনওই কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নেবে না এরা যাতে পল্লীবাসীর মনে কৌতূহলের উদ্রেক হয় বা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সামনে পড়তে হতে পারে। সবচেয়ে পছন্দের এলাকা ব্যস্ত অফিসপাড়া এবং বড় বড় ধর্মস্থান যেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয়। যেখানে বিশেষ প্রয়োজন অথবা উদ্দেশ্যে সদাব্যস্ত মানুষজনের মধ্যে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা বা এ নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এবং সুযোগ কোনওটাই নেই। অতঃপর ওই ভিক্ষুকদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিয়েছিলাম বিশেষভাবে আমার মূল-উত্তরদাতা অর্থাৎ ‘কী ইনফরম্যান্ট’ হিসেবে। ইয়া তালড্যাঙা চেহারার লোকটা। প্রৌঢ়, একগাল দাড়ি। আদুল গা, সবসময় নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া হেঁটো লুঙ্গি, কাঁধে নেতিয়ে পড়ে থাকা একটা বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। মুখে সর্বদা লেগে থাকা একটা মেকি করুণ হাসি, হঠাৎই এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও ভ্রাম্যমাণ পথচারীর। গলায় কাতর আবেদন— “বাচ্চাটা তিনদিন খায়নি গো বাবু…।” হতচকিত পথচারী। কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিতও। কোনওমতে মানিব্যাগ খুলে তাড়াতাড়ি যা পারে দিয়ে পা বাড়াত গন্তব্যস্থলের দিকে। সপ্তাহের বাকি ছ’দিন এই একই কায়দায় ভিক্ষে করলেও ফির জুম্মাবারে (শুক্রবার) দাঁড়িয়ে পড়ত কোনও সংখ্যালঘু এলাকার মসজিদের সামনে। জুম্মাবার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। দুপুরের নামাজ সেরে বেরোনো পুণ্যার্থীরা উদার হস্তে দান করেন ওই দিনটায়। মসজিদের একপাশে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো ভিক্ষুকদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ত লোকটা। রোজগারপাতি সবচেয়ে বেশি হত ওই জুম্মাবারেই। প্রায় টানা হপ্তা তিনেক অনুসরণ করে ধরতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা। অতঃপর এক শুক্রবার লোকটার পিছু নিয়ে চড়ে বসেছিলাম সাউথ লাইনের ট্রেনে। বিনা টিকিটের যাত্রী হয়ে। কারণ লোকটা কোথায় যাবে জানা ছিল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে একটা প্রায় নির্জন ছোট স্টেশন। সেখানে নেমে পড়ল লোকটা। পিছু পিছু এই অধম প্রতিবেদক। ট্রেন থেকে নামা সামান্য দু’-চারজন যাত্রী প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই বিলকুল শুনশান এলাকা। প্ল্যাটফর্মের একধারে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল লোকটা। তারপর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল ধীরে ধীরে। “মকবুল.. ও মকবুল… এবার ওঠ।” আস্তে আস্তে চোখজোড়া খুলল। মিনিট দুয়েক বাদে ঘোরলাগা চোখে উঠে বসল বাচ্চাটা। কাঁধের ঝোলা থেকে দুটো বিস্কুট বের করে বাচ্চাটাকে খেতে দিল লোকটা। আর একমুহূর্তও দেরি না করে ঝটিতি গিয়ে বসে পড়েছিলাম বেঞ্চিতে বুড়োর পাশে। হাতে একটা একশো টাকার নোট (তখনকার বাজারে অনেক টাকা) গুঁজে দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম রহস্যটা। যা জেনেছিলাম সেটা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন কেন একটু আগে ‘হাড় হিম করে দেওয়া’ উপমাটা ব্যবহার করেছিলাম। বাচ্চাটা আসলে বুড়োর নিজের নয়। ভাড়া করা। এই দখিন লাইনের অগুনতি অজ পাড়াগাঁয়ে এরকম অজস্র হাড়হাভাতে, বেমতলব গরিবগুরবো পরিবার মুখিয়ে রয়েছে তাদের ঘরের বাচ্চাকে ভাড়া খাটানোর জন্য। কারণ একটাই—অপরিসীম দারিদ্র্য। নিজেরা বেশিরভাগই নিজে কাজটা করতে পারে না ঘুম পাড়ানোর কায়দাটা না জানার জন্য। সীমিত সংখ্যক মানুষেরই আয়ত্তে রয়েছে বিদ্যেটা। এই প্রৌঢ় তাদের মধ্যে একজন। ওর বয়ান অনুযায়ী নিশাদলের গাঁট (একধরনের বিষাক্ত মাদক গাছের শিকড়), আফিম, কামপোজ-হিপটোজেন-প্রক্সিভন-ম্যানডেক্সের মতো ঘুমপাড়ানি ওষুধ পরিমাণমতো মিশিয়ে তৈরি করা হয় মিশ্রণটা। জানতে হয় দুধের সঙ্গে কতটা পরিমাণে মিশিয়ে খাওয়ালে কতক্ষণ ঘুমোবে বাচ্চাটা আর কতক্ষণ বাদেই বা সে ঘুম ভাঙবে। পরিমাণে একচুল এদিক ওদিক, সামান্যতম অসতর্কতা, ঘুম পরিণত হবে কালঘুমে। এলাকার অনেক কোয়াক ডাক্তারও অনেক সময় সাহায্য করে থাকেন মিশ্রণটা বানাতে। বুড়োর মতে এক থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি কোনও বাচ্চাকে খাটানো যায় এই লাইনে। মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি কাম্য। এক থেকে দেড় বছর বয়েসি বাচ্চার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি ভাড়ার টাকার পরিমাণও। কারণ বয়স যত কম হবে ততই দয়ামায়ার উদ্রেক হবে মানুষের মনে। তবে একটানা এ ব্যাবসায় কখনওই খাটানো যায় না একটি শিশুকে। মোটামুটি ছ’মাস অন্তর অন্তত এক মাসের টানা বিশ্রাম প্রয়োজন অতি অবশ্যই। কিন্তু প্রৌঢ়র কথাতে তা আর হয় কই। ভয়ংকর গরিব সব পরিবার। চাহিদার তুলনায় বাচ্চার জোগান অনেক বেশি। অনেকটা সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের ভাষায়— “এ মহাভারত দাদা, এ মহাভারত/ মাছের মতোই আছে শিশুর আড়ৎ/ জ্বালানির মতো আছে শিশুর জোগান/ মহাভারতের কথা অমৃত সমান…।” সেই জোগানে একবার ছেদ পড়ে গেলেই অন্যের বাচ্চা এসে দখল নিয়ে নেবে জায়গাটার। এর মানে বহুদিন রোজগার থেকে বঞ্চিত থাকা। এদিকে পেটের মধ্যে দাউ দাউ খিদের আগুন। ফলে চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়েও দরিদ্র অভিভাবকেরা তাদের শিশুটিকে ঘুমের হাটে ভাড়া খাটিয়ে যান। টানা বছরের পর বছর। কত টাকায় বাচ্চা ভাড়া পাওয়া যায়? ভাড়া চুকিয়ে কতটা লাভ থাকে হাতে? এর জন্য কাউকে পয়সা খাওয়াতে হয় কি? যারা ভাড়া দেন সেইসব পরিবারগুলোর কারও সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে কি? প্রশ্ন করামাত্র শক্ত হয়ে গেছিল বুড়ো। “সেসব অনেক গভীর বেত্তান্ত বাবু… খামোখা শুধোয়ে বেপদ বাড়াবেন না। চল চল মকবুল। ইদিকে অনেকটা পথ যেতি হবে…।” বলতে বলতেই তাড়া লাগিয়েছিল বাচ্চাটাকে। পরমুহূর্তেই বাচ্চাটার হাত ধরে হেঁটে চলে গিয়েছিল হন হন করে। একবারও পিছনে না তাকিয়ে। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে। হঠাৎই ঘোর কেটে খেয়াল পড়েছিল আসার সময় টিকিট কাটা হয়নি। বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে হাঁটা লাগিয়েছিলাম টিকিট কাউন্টারের দিকে। এবার ফেরার পালা।
মাঝখানে এই আমরা আছি…
ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে শ্যামবাজারের দিকে যেতে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের একটু আগে হাতের বাঁপাশে জটাধারী পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পের ঠিক গা ঘেঁষে সোনাগাছি লেন ধরে দু’-চার পা এগোলে ডানদিকে নীলমণি মিত্র স্ট্রিট। রাস্তার দু’ধারে গিজগিজ করছে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী মেয়েরা। গলিতে ঢোকামাত্র কাস্টমারকে ঘিরে ধরবে একদল লোক। প্রায় সবার পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, ফতুয়া আর লুঙ্গি। অনেকটা ইউনিফর্মের মতো। ছিনে জোঁকের মতো পিছনে লেগে যাবে লোকগুলো, ক্রমাগত ফিসফিস করে যাবে কানের কাছে— “আইয়ে সাহাব, মেরা সাথ আইয়ে… অ্যায়সি চোখি চিজ (দুর্দান্ত জিনিস) দিখাউঙ্গা কি দিল খুশ হো যায়গি… একদম ফিল্ম হিরোইন কি তরহা…।” এই ঘ্যান ঘ্যান চলতেই থাকবে যতক্ষণ না কাস্টমার অতিষ্ঠ হয়ে ওদের মধ্যে কারও একজনের সঙ্গে আশপাশের কোনও একটা বাড়িতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়। আসলে ওই লোকগুলো দালাল। সোনাগাছিতে যৌনকর্মীদের মোটামুটিভাবে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সাধারণত বাজারদর, সৌন্দর্য, ব্যবহার/ ছলাকলা এবং দৈহিক গঠনের ওপর নির্ভর করেই এই ক্যাটাগরির ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করা হয়। সোনাগাছিতে, বিশেষ করে অবিনাশ কবিরাজ রো, নীলমণি মিত্র স্ট্রিট, ডালপট্টি, সোনাগাছি লেনে এরকম বেশ কিছু ‘এ’ ক্যাটাগরি বাড়ি রয়েছে। যেরকম ‘ড্রিম কুইন’, ‘নাইট লাভার্স’, ‘নন্দরানির ফ্ল্যাট’, ‘নীলকমল’, ‘শ্রীকমল’ ইত্যাদি। এলাকায় অনেকদিনের যাতায়াত বা বহু পুরনো খদ্দের না হলে দালালদের সাহায্য ছাড়া ওইসব বাড়িগুলোয় ঢোকা প্রায় অসম্ভব। ওরা কখনওই কাস্টমারের থেকে একটি পয়সাও চাইবে না। যে মেয়েটির ঘরে কাস্টমার ঢুকবে তার কাছ থেকে কুড়ি বা পঁচিশ পার্সেন্ট হারে কমিশন নিয়ে নেবে। ২০০৬-২০০৭, সোনাগাছিতে নিজস্ব এবং স্বশাসিত একটি সংস্থায় পাচার বিরোধী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় ওই এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করার সুবাদে দালালদের (স্থানীয় ভাষায় দাল্লা/ ভারুয়া) অনেকের সঙ্গেই বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই জানতে পেরেছিলাম এদের কারও রোজগার দিনে সাড়ে সাতশো থেকে হাজার টাকার নীচে কখনওই নয়। ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন থাকলে কখনও কখনও অঙ্কটা পাঁচ হাজারেও গিয়ে দাঁড়ায়। যা অনেক হাই প্রোফাইল কোম্পানি এক্সিকিউটিভকেও রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিতে পারে। এই দালালদের অধিকাংশই আদতে উত্তরপ্রদেশের মানুষ। এর পিছনেও একটা নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা শহরের নিষিদ্ধ পল্লীগুলোয় নব্য বাঙালি বাবুরা ছিলেন যৌনকর্মীদের মুখ্য পৃষ্ঠপোষক। শুধু লাম্পট্যই নয় তাদের রক্ষিতাদের নৃত্যগীত সহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলায় পারদর্শিনী করে তোলাটাও ছিল বাবুদের বিনোদনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই সময় সোনাগাছি নয়, পার্শ্ববর্তী রামবাগান এলাকাই ছিল শহরের সেরা যৌনপল্লি। উনিশ শতকের শেষে থেকে ধীরে ধীরে বাবু সভ্যতার পতন এবং মারোয়ারি শ্রেষ্ঠীদের উত্থানের হাত ধরে রামবাগান দ্রুত তার কৌলীন্য হারাতে থাকে আর একই সঙ্গে সোনাগাছিতে উত্তরপ্রদেশ মূলত আগ্রা থেকে একশ্রেণির যৌনকর্মীর আগমন ঘটে। এলাকায় এরা ‘আগ্রাওয়ালী’ বা ‘বেরিয়া’ নামে পরিচিত। এদের প্রায় সকলেই অসামান্য রূপসী এবং দেহসৌন্দর্যের অধিকারী। বর্তমানে সোনাগাছিতে এরাই সবচেয়ে ‘হাই প্রোফাইল’ যৌনকর্মী। এলাকার প্রায় সবক’টা ‘এ-ক্যাটাগরি’ বাড়ির সিংহভাগই এদের দখলে। এদের হাত ধরেই এই উত্তরপ্রদেশীয় দালালদের কলকাতা তথা সোনাগাছিতে পা রাখা। এলাকার অর্থনীতির একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রক এই উত্তরপ্রদেশীয় যৌনকর্মী এবং দালালেরা। এ ছাড়াও আরেকটি শ্রেণির উপস্থিতি সোনাগাছিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুপুরবেলা কখনও যদি ওই চত্বরে ঢুকে পড়েন নাকে ঝাপটা মারবেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসা মনকাড়া রান্নার গন্ধ। ঘরের পাশে, বারান্দার ধারে প্লাইউডের পার্টিশন ঘেরা একফালি জায়গায় রান্না চড়িয়েছেন একদল মানুষ। এদের সকলেরই আদি নিবাস ওড়িশা অথবা পূর্ব মেদিনীপুর। চাকর না বলে এককথায় এদের সোনাগাছি ‘অল পারপাস জব পারসোনেল’ বলা যেতে পারে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে জল তোলা, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়পোঁছ মায় খদ্দেরদের মদ-চাট-কোল্ড ড্রিংকস এনে দেওয়া, সমস্ত কাজ এরা সামলান অত্যন্ত দক্ষ হাতে। ফলে নিষিদ্ধ পল্লির মালকিন বা বাড়িওয়ালিদের এদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় অনেকটাই। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাড়িওয়ালিরা মাসিক একটা নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে এই চাকরদের হাতে ব্যাবসার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন।